শ্রাবণী ব্যানার্জী |
পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা থাকে যাদের স্মৃতি বহু বছরেও এতটুকু ম্লান হয় না আর সেই রকম একটি দেশ
হল ইজিপ্ট। ছোটবেলায় ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে’ গানটা গাইতে গাইতে মাকে
জিজ্ঞাসা করেছিলাম “মা মমি কি? সেই দেশটা কোথায়?” মা অত্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকায়
মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে মিশরের ভৌগোলিক লোকেশন ও মমি সম্বন্ধে একটা বক্তৃতা দিয়ে
তার কাজ সেরেছিলেন। হায়! পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস কি পাঁচ মিনিটে বলা যায়? তাই বড়
হয়ে একবার গ্রীসের এথেন্স শহর থেকে সেই ‘সাহারা মরু পারে’ মমির দেশে গিয়ে হাজির
হয়েছিলাম।
মিশরকে যে
কেন নীল নদের দান বলে সেটা প্লেন থেকেই নীচের দিকে তাকিয়ে টের পেয়েছিলাম। নীল নদের
দুধারে কেউ যেন দুটো চওড়া সবুজ ফিতে মাটির ওপরে পেতে রেখেছে আর তারপরেই শুধু বালি
আর বালি। তাই এ নদটি না থাকলে কোনও রকম চাষ আবাদ বা সভ্যতা এদেশে গড়ে উঠত না সেই
বিষয়ে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না। কায়রোতে হোটেল
আগে থেকেই বুক করা ছিল। কিন্তু ঢোকার মুখেই একটি ছেলে জানিয়ে দিল ওরা ওভারবুক করে
ফেলেছে তাই এই হোটেলে কোনও জায়গা নেই। তবে কাছেই আর একটি হোটেলে ওরা থাকার
ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। আমরা তো শুনেই হাঁ। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের ওপর চোটপাট করতে
সে বলল আমাদের ঘর ঠিকই রাখা আছে আর বাইরের ছেলেটা অত্যন্ত পাজি তাই নিজের হোটেলে
নিয়ে যাবার জন্য এটাকে ফুল বলেছিল। এসব ঘটনা নাকি কায়রোতে হামেসাই হয়।
নীলনদ
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়েই সোজা ছুটলাম
গিজার পিরামিড দেখতে। খচ্চরের পিঠে চেপে পিরামডের খুব কাছেই চলে যাওয়া যায়। তিনটে
পিরামিডের মধ্যে সব থেকে বড় হল ‘খুফু’ বা ‘চিয়পস্-এর পিরামিড। প্রাচীন যুগের
সপ্তম আশ্চর্য্যের মধ্যে এটাই একমাত্র সাড়ে চার হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায়
তেইশ লক্ষ বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি, যাদের মধ্যে আবার অনেকেরই ওজন প্রায় ষোলো টন।
কিভাবে পাহাড় থেকে কেটে নীল নদে ভাসিয়ে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল সেটা ভাবতে গেলে
এ যুগের চোখ প্রায় কপালে উঠে যায়। যখন চিন্তা করি পুলি, চাকা বা লোহার যন্ত্রপাতি
সাহায্য ছাড়াই এই প্রায় পঞ্চাশতলা উঁচু সৌধটি তৈরী হয়েছিল সেটা ভাবতে গেলে সত্যিই
মাথার ঠিক থাকে না।
পিরামিডের ভেতরে ঢোকাটা যে এতটা কষ্টকর হবে বাইরে থেকে দেখে খুব একটা বুঝতে পারিনি। একটিই মাত্র সরু যাতায়াতের রাস্তা সেখানে প্রায় সেমি হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। প্রায় দমবন্ধ হওয়া অবস্থাতে বেশ কিছুটা যাবার পর সেই বিশাল চেম্বারে ঢোকার সৌভাগ্য হল। রাজারানীর সমাধিস্থল ও একটি একশো তেতাল্লিশ ফিট কাঠের নৌকা ছাড়া আর বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না। কারণ ভেতরে ধনসম্পত্তি বা সোনাদানা যা ছিল চোরেরা বহুদিন আগেই সব লুটেপুটে নিয়ে চলে গেছে। পিরামিডের বাইরে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির মুক্ত বাতাসে মনে হল যেন ধড়ে প্রাণ এল। নতুন অবস্থাতে এই তিনটে পিরামিডই সাদা চুনাপাথরে মোড়া ছিল এবং সেটাকে পালিশ করে মার্বেলের মতো ঝকঝকে করে রাখা হত। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় পিরামিডকে মোড়ানো সাদা ঝকঝকে পাথরটি দূর থেকে আয়নার মতনই দেখতে লাগত। আর তাতে সূর্যের আলো পড়ে মনে হত যেন একটি প্রকান্ড তারা স্বর্গ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। এখন মাথার চূড়াটুকু ছাড়া আর কোনওভাবেই সেটা বোঝার উপায় নেই। দুঃখের বিষয় কালের কবলে নয় মাত্র ছ’শো বছর আগে আরবরা এগুলিকে ভেঙে নিয়ে কায়রোর বহু মস্ক তৈরী করে। পিরামিডের সামনে সিংহের শরীর ও মানুষের মুখ নিয়ে গম্ভীরভাবে স্পিংস বসে আছে যার আকার আয়তন দেখলে বেশ শ্রদ্ধা জাগে। একটি পাথর কেটে করা চুয়াত্তর মিটার লম্বা ও কুড়ি মিটার চওড়া স্পিংস্ যেন সব শত্রুর হাত থেকে পিরামিডদের রক্ষা করবে বলে সামনে থাবা গেড়ে বসে আছে। স্পিংস্-এর নাকটা দেখলাম অনেকটাই ভাঙা আর দাড়িরও বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। কারণ, শোনা যায় নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সৈন্যরা স্পিংস্-এর নাকে টার্গেট প্রাকটিস্ করে বন্দুকের গুলিতে তার নাক ও দাড়ির অনেকটাই উড়িয়ে দেয়। রাতে লাইট অ্যাণ্ড সাইন্ড দেখে মনে হচ্ছিল আমরাও যেন মনে মনে হাজার হাজার বছর পিছিয়ে গেছি। বার বার ভাবছিলাম আহা স্পিংস্ যদি একটু কথা বলতে পারতো তাহলে ওর থাবার কাছেই হয়তো আমি সারাদিন বসে থাকতাম।
গিজার পিরামিড
পিরামিডের ভেতরে ঢোকাটা যে এতটা কষ্টকর হবে বাইরে থেকে দেখে খুব একটা বুঝতে পারিনি। একটিই মাত্র সরু যাতায়াতের রাস্তা সেখানে প্রায় সেমি হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। প্রায় দমবন্ধ হওয়া অবস্থাতে বেশ কিছুটা যাবার পর সেই বিশাল চেম্বারে ঢোকার সৌভাগ্য হল। রাজারানীর সমাধিস্থল ও একটি একশো তেতাল্লিশ ফিট কাঠের নৌকা ছাড়া আর বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না। কারণ ভেতরে ধনসম্পত্তি বা সোনাদানা যা ছিল চোরেরা বহুদিন আগেই সব লুটেপুটে নিয়ে চলে গেছে। পিরামিডের বাইরে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির মুক্ত বাতাসে মনে হল যেন ধড়ে প্রাণ এল। নতুন অবস্থাতে এই তিনটে পিরামিডই সাদা চুনাপাথরে মোড়া ছিল এবং সেটাকে পালিশ করে মার্বেলের মতো ঝকঝকে করে রাখা হত। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় পিরামিডকে মোড়ানো সাদা ঝকঝকে পাথরটি দূর থেকে আয়নার মতনই দেখতে লাগত। আর তাতে সূর্যের আলো পড়ে মনে হত যেন একটি প্রকান্ড তারা স্বর্গ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। এখন মাথার চূড়াটুকু ছাড়া আর কোনওভাবেই সেটা বোঝার উপায় নেই। দুঃখের বিষয় কালের কবলে নয় মাত্র ছ’শো বছর আগে আরবরা এগুলিকে ভেঙে নিয়ে কায়রোর বহু মস্ক তৈরী করে। পিরামিডের সামনে সিংহের শরীর ও মানুষের মুখ নিয়ে গম্ভীরভাবে স্পিংস বসে আছে যার আকার আয়তন দেখলে বেশ শ্রদ্ধা জাগে। একটি পাথর কেটে করা চুয়াত্তর মিটার লম্বা ও কুড়ি মিটার চওড়া স্পিংস্ যেন সব শত্রুর হাত থেকে পিরামিডদের রক্ষা করবে বলে সামনে থাবা গেড়ে বসে আছে। স্পিংস্-এর নাকটা দেখলাম অনেকটাই ভাঙা আর দাড়িরও বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। কারণ, শোনা যায় নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সৈন্যরা স্পিংস্-এর নাকে টার্গেট প্রাকটিস্ করে বন্দুকের গুলিতে তার নাক ও দাড়ির অনেকটাই উড়িয়ে দেয়। রাতে লাইট অ্যাণ্ড সাইন্ড দেখে মনে হচ্ছিল আমরাও যেন মনে মনে হাজার হাজার বছর পিছিয়ে গেছি। বার বার ভাবছিলাম আহা স্পিংস্ যদি একটু কথা বলতে পারতো তাহলে ওর থাবার কাছেই হয়তো আমি সারাদিন বসে থাকতাম।
কায়রো মিউজিয়াম
ইজিপ্টের
দ্বিতীয় দিনে আমরা কায়রো মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। এখানে ইজিপ্টের ও গ্রীসের বহু
সংগ্রহের সাথে সাথে বিখ্যাত ফ্যারাদের মমিও রাখা আছে। তবে সব থেকে চোখ কাড়ে তুতেন খামেনের সংগ্রহশালা। এই বালক ফ্যারোর সমাধিস্থলই একমাত্র চোরেদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
১৯২২ সালে বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার ইজিপ্টের ‘ভ্যালি অফ দ্যা কিং’
থেকে এটিকে আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেন। সবাই সেদিন সাড়ে তিন হাজার
বছর আগের সেই আঠারো বছরের কিশোর ফ্যারার কথা জানতে পারে। অনেক সোনার জিনিস পাওয়া
গেলেও সব থেকে চোখে পড়ে এগারো কেজি খাঁটি সোনার একটি মুখোস। নীল রং ও সোনা দিয়ে
তৈরী এই মুখোসটি বালক ফ্যারোর মুখের আদলে করা হয়েছিল। এই মিউজিয়ামে মানুষের সাথে
জন্তু-জানোয়ারদের মমি দেখতে পেলাম।
মমি
ফেরার পথে
একটি অল্প বয়সী ছেলে আমাকে সিস্টার বলে ডেকে এগিয়ে এলো। সে নাকি কায়রোর আমেরিকান
ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তাই আমাদের সাথে একটু ইংরেজি প্র্যাকটিস করতে চায়। পাশ থেকে
আমার স্বামীর সাবধান বাণী শুনলাম “আমাদের গায়ের রঙের লোকেদের সাথে কোন দুঃখে ইংরেজি
প্র্যাকটিস্ করতে আসবে নিশ্চয়ই টকানোর তালে আছে।” সদ্য দিদির পোস্ট পেয়ে সেকথা
অগ্রাহ্য করে আমি গাসিলের সাথে গল্পে মেতে উঠলাম এবং তাকে সঙ্গে করে ‘ফলাফল’
রেষ্টুরেন্টে খেতে গেলাম। কথায় কথায় গাসিল জানালো জগৎ বিখ্যাত বক্সার মহম্মদ আলী
তার বাবার দোকান থেকে আতর কেনে। তাই আমরাও একবার দোকানে গেলে সে অত্যন্ত খুশি হবে।
দোকানে গিয়ে মহম্মদ আলীর সাথে ওর বাবার ছবি দেখে মোহিত হয়ে আমিও ঝটপট কয়েকটি আতর
কিনে ফেললাম এবং পরক্ষণেই দেখতে পেলাম একটি বুড়ো মত লোক আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে
গেল। আর আমার স্বামী বললেন ওই বয়স্ক লোকটাই নাকি গাসিলের সত্যিকারের বাবা অর্থাৎ
মহম্মদ আলীর পাশে তোলা ছবিটা নাকি ওর বাবাই নয়।
মানুষকে সন্দেহ করা মহাপাপ সেই সম্বন্ধে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে আমি
আতরগুলি নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম। বলাবাহুল্য পরের দিনই আমার ভাই গাসিল ও তার আতরের
গন্ধ দুটোই আমার জীবন থেকে সম্পূর্ণ কর্পূরের মত উবে গেল।
মহম্মদ আলী মস্ক
কায়রোর
তৃতীয় দিনে আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল ‘মহম্মদ আলী মস্ক’। বিশাল অ্যালাবাস্টারের
মস্কটা অনেক উঁচুতে তৈরী করায় কায়রো শহরে যেখানেই লোক থাকুক না কেন এটা চোখে
পড়বেই। আমাদের হোটেলটি এর খুব কাছে হওয়ায় ভোরবেলা মিষ্টি আজানের সুরে আমাদের ঘুম
ভাঙ্গত। তবে মস্কটিকে কাছ থেকে দেখে বুঝলাম এরমধ্যে টার্কিশ প্রভাব প্রচন্ড।
ইস্তামুলের ‘হায়া সেফিয়া’ মস্কের সাথে এর মিল চোখে পড়ার মত। সন্ধ্যেবেলা ঠিক করলাম
কায়রোর বিখ্যাত বাজার ‘খানেনখলিলি’ দেখতে যাবো। এই আটশো বছরের পুরনো বাজারটিও
পুরোপুরি টার্কিশ ধাঁচে তৈরী যেখানে কাবার কফি থেকে আরম্ভ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। পরের দিন খুব ভোরবেলা ‘লাক্সার’ যাবার প্লেন ধরতে হবে
বলে তাই তাড়াতাড়ি কিছু কোপ্তা, ঘন দুধ ও বাদাম দেওয়া গরম ইজিপসিয়ান পুডিং ‘ওম আলী’
খেয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম।
কর্ণাক টেম্পিল
প্লেন মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই আমাদের কায়রো থেকে লাক্সারে পৌঁছে দিল। হোটেলে জিনিসপত্র রেখে একটি টাঙ্গা নিয়ে ‘লাক্সার’ ও ‘কর্ণাক’ টেম্পিলের দিকে রওনা হলাম। ‘লাক্সার’ টেম্পিলে ঢোকার মুখে থেকেই দেখলাম দুধারে সার দিয়ে বিরাট বড় বড় ভেড়ার মাথাওয়ালা স্পিংস্রা বসে আছে যেন এদের কাজই লোকজনকে মন্দিরে ঢোকার আগে অভ্যর্থনা জানানো। ঢোকার মুখেই বিরাট পাথরের গেট আর তার পাশে একটি উঁচু স্মারক স্তম্ভ। গেট পেরিয়ে যতটা কর্ণাক টেম্পিলের দিকে এগোতে লাগলাম ততই তার আয়তন ও স্তম্ভের উচ্চতা দেখে বিস্ময়ে মুখ এতটাই হাঁ হয়ে গেল যে ঘোর কাটতেই আমার বহুক্ষণ সময় লেগেছিল। সারি সারি স্তম্ভগুলোর নীচে মানুষদের যেন পিঁপড়ের মত দেখতে লাগছিল। মাঝখানে ‘আমুন’ দেবতার মন্দির এবং তাকে ঘিরে অজস্র স্তম্ভ আর তাদের গায়ে বহু কিছু হাইরোগ্লিফিকে লেখা যা পড়ার ক্ষমতা অবশ্যই আমাদের ছিল না। এই মন্দিরের সাইজ যা তাতে নিউ ইয়র্কের হাফ ম্যা্নহ্যাটন কভার হয়ে যায় পঞ্চাশ হাজার স্কোয়ার ফিটের এই মন্দিরে একশো চৌত্রিশটা স্তম্ভ ষোলোটা সারি দিয়ে দাঁড় করানো যাদের অনেকেরই উচ্চতা বাইশ মিটার অর্থাৎ সত্তর ফিটের ওপর। শুধু তাই নয় এদের মাথা আবার বড় বড় বিম দিয়ে ঢাকা। এসব পেরিয়ে দেখলাম আবার বিরাট মন্দির এবং সেই মন্দিরের পাশে একটি জলাধার। এই যুগেও এই মন্দিরের বিশালতা ও স্ট্যাচুর সাইজ দেখে মাথা ঘুরে যায় আর প্রায় চার হাজার বছর আগে ক্রেনের সাহায্য ছাড়া এটি কিভাবে তৈরী করেছিল সেটা চিন্তা করলে বিস্ময়ের ক্ষমতাটাও যেন ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যায়। সেদিন রাতে চার হাজার বছরের কর্ণাক টেম্পিলে লাইট অ্যান্ড সাইন্ড দেখে মনের মধ্যে যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল যার স্মৃতি আজও এতটুকু নষ্ট হয়নি।
আবুসিম্বল
পরের দিন
সকালে আসোয়ান যাবো বলে ট্রেনের টিকিট কাটতে গেলাম। লোকজন বলল যদিও ট্রেন সকাল
আটটায় কিন্তু এদেশে দু-তিন ঘন্টা লেট্কে লোকে লেট্ বলে গন্য করে না। তাই আটটার
বদলে দশটায় ট্রেন ছাড়তেই আমরা বেশ খুশি হলাম। এই তিন ঘন্টা ট্রেন জার্নিতে একটিই
উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল- এক স্যুইস ভদ্রলোকের সাথে আলাপ, যিনি নাকি পৃথিবীর প্রায়
প্রতিটি দেশেই ঘুরেছেন। উনি ভারতবর্ষ থেকে মোটর সাইকেল চেপে পাকিস্তান ইরান ইরাক
ঘুরে স্যুইজারল্যাণ্ড পর্যন্ত গেছেন। শুনে মনে হল তখনি একটু পায়ের ধুলো নিই। এই
যুগেও যে হিউয়েন সাংরা পৃথিবীতে বিচরণ করে কে জানতো! স্যুজারল্যাণ্ডের সবুজ পাহাড়ে
ঘেরা শান্ত নিরুপদ্রব জীবন থেকে গিয়ে ভারতবর্ষের জনসমুদ্র দেখে উনি নাকি অত্যন্ত
আনন্দ পেয়েছিলেন। আমাদের বললেন কাশীর ফ্যাসিনেটিংগলি থেকে আরম্ভ করে থর মরুভূমিতে
উটের পীঠে চাপার মধ্যে এমন একটা উন্মাদনা আছে যা পৃথিবীর কোথাও উনি খুঁজে পাননি।
ওনার সাথে বিভিন্ন দেশ নিয়ে গল্প করতে করতে একসময়ে আমরা আসোয়ানে পৌঁছে গেলাম।
নীলনদের
ধারেই আমরা যে হোটেলটি বুক্ করেছিলাম সেখানে জানলা খুললেই চোখের সামনে নদটা যেন
ঝলমল করে উঠতো। আসোয়ানের রাস্তাতেই দেখলাম দুধারে জিনিস বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু
হকারের ঠেলায় হাঁটে কার সাধ্যি। হিন্দি সিনেমার দৌলতে আমাদের স্ট্যাটাস্ দেখলাম
সাহেব সুবোদের থেকে ঢের বেশী। অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা থেকে মিঠুন চক্রবর্তীর
‘ডিস্কো ড্যান্সার’ সবই মনে হল খুব জনপ্রিয়। সবাই বলল আমরা অমিতাভ বচ্চনের দেশের
লোক তাই সস্তাতেই জিনিস ছেড়ে দেবে। সুতারাং একবার দেখতে ক্ষতি কি? একটা বিরাট
দোকানে দেখলাম প্যাপিরাস বানানো দেখাচ্ছে। কারণ কাগজ আবিষ্কারের বহু আগেই মিশরীয়রা
তাদের অনেক কাহিনী এই প্যাপিরাসে লিখে রাখতো। প্যাপিরাসের গাছের ছাল ফালি ফালি করে
কেটে জলে পচিয়ে উদ্বৃত্ত জলটিকে বার করে পেষ্ট করা হতো। অনেকটা আমাদের দেশের
চাটাই-এর মতো দেখতে লাগল। আসল প্যাপিরাসের দাম খুব বেশী। তাই
অনেকেই নাকি কলার খোসা ভেজাল দেয়, যদিও সাবধান করে দিচ্ছে তাদের দোকান থেকে না
কিনে অন্য কোথাও গেলে কপালে কলার খোসা ছাড়া নাকি আর কিছুই জুটবে না। সেদিন বিকেলে
যখন নীল নদেতে একটা মিনি ক্রুজ নিলাম তখন আনন্দে হকারদের অত্যাচারের কথা
কিছুক্ষণের জন্য পুরোপুরিই ভুলে গিয়েছিলাম। বোট থেকে যখন ডাঙায় নামছি তখন আলতো করে
হাতটা ধরেই বলল বক্শিশ।
ইজিপ্টের
বক্শিশ সম্বন্ধে একটা কথা জানিয়ে রাখি, এরা প্রতিটি বাক্যে একবার করে বক্শিশ শব্দটা
উচ্চারণ করে। আপনি বক্শিশ সমেত দরদাম করে টাঙ্গায় উঠলেন নেমে শুনলেন টাঙ্গাওয়ালা
তার আদরের ঘোড়ার জন্য বক্শিশ চাইছে
অর্থাৎ নিজেরটা তো হয়েই গেছে তাহলে তার ঘোড়াই বা বঞ্চিত হয় কেন? ট্যাক্সি
যেখানেই থামছে কিছু বাচ্ছা ট্যাক্সির দরজাটা তাড়াতাড়ি খুলে দিয়ে বলছে বক্শিশ। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে ঘুরছেন একটা বাচ্চা আপনার ভার লাঘব করার জন্য
কাঁধ থেকে প্রায় ব্যাগটি কেড়ে নিয়ে বলল বক্শিশ।
পরেরদিন ভোর চারটেতে ভ্যানে চেপে আমরা আবুসিম্বলের
দিকে রওনা হলাম। ভ্যানের যাত্রী সবশুদ্ধ সাতজন তার মধ্যে তিনজন আবার ইটালিয়ান।
যেতে আমাদের সময় লেগেছিল সাড়ে চার ঘন্টা আর সেদিনই মরুভূমি কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে
টের পেয়েছিলাম। চারিদিকে শুধু বালি আর বালি আর তার মধ্যে দিয়ে একটিই রাস্তা যেটা
নাকি বালির ঝড়ে অনেক জায়গাতেই ঢাকা। যতই আমরা নুবিয়ান মরুভূমির মধ্যে ঢুকতে লাগলাম
ততই আশেপাশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠল। বালির ওপর বেশ কয়েকটা উটের কঙ্কাল পড়ে
থাকতে দেখলাম। কিছুদূর আবার যাবার পর আপাদ-মস্তক সাদাকাপড়ে ঢাকা একটি লোককে উটের
পিঠে যেতে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম, মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটা লাইন
‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’। কবিতাতে যতই গ্ল্যামারাস লাগুক না কেন দেখলাম ওই
কাঠ ফাটা গরম ধূ ধূ মরুভূমিতে বাস্তবে বেদুইন হওয়া অত সহজ ব্যাপার নয়, মনে আছে
ফেরার পথে হঠাৎ দূরে সুন্দর নীল জল দেখে বেশ লাফিয়ে উঠেছিলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই
ড্রাইভার আমার ভুল সংশোধন করে বলেছিল ওটা জল নয় মরীচিকা।
‘আবুসিম্বলে’ যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সকাল নটা। একটা পাহাড় কেটে ‘র্যামসি
দ্য গ্রেট’ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এটিকে তৈরী করেন। মন্দিরটি আমুনের নামে
উৎসর্গ করা হলেও দেখে মনে হল র্যামসি নিজেকে ভগবান বানিয়ে নিজের ঢাক পিটিয়ে
গ্যাছেন। ইজিপ্টের লোকের আয়ু যখন গড়ে চল্লিশ বছরের বেশী ছিল না তখন র্যামসির
মৃত্যু হয় তিরানব্বই বছর বয়সে। ওনার মত শক্তিশালী ফ্যারো ইজিপ্টের ইতিহাসে বোধহয়
আর কেউ ছিল না। অজস্র স্ত্রী ও দেড়শোজনের ওপর ছেলেমেয়ে নিয়ে উনি সাতষট্টি বছর
রাজত্ব করেছিলেন। প্রথমেই চোখে পড়ে প্রকাণ্ড উঁচু চারটে র্যামসির বসা মূর্তি।
ওনার হাঁটুর নীচে ওনার সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী নাফারতরি ও ফ্যারোর প্রথম দিকের কিছু
সন্তানের মূর্তি। উঁচু
পিলার এই মূর্তিগুলোকে সাপোর্ট করছে তাই সব সমেত এদের উচ্চতা একত্রিশ মিটার।
প্রতিটি মানুষকে এই স্ট্যাচুগুলোর তলায় এতটাই ক্ষুদ্র ও নগণ্য লাগছিল যেন সাড়ে তিন
হাজার বছর বাদেও র্যাম্সি বুঝিয়ে দিচ্ছে তার স্ট্যাটাস্। নূবিয়ানদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ জয় করে উনি এই মন্দিরটি বানান। তাই ভেতরে ঢুকে
দেখলাম চতুর্দিকেই ওনার কীর্তি কাহিনী আঁকা আছে। একটা ছবিতে দেখলাম র্যাম্সি
নূবিয়ানদের চুলের মুঠি ধরে কচুকাটা করছেন। এখন অবশ্য ঐতিহাসিকরা বলেন বেশীরভাগ
ক্ষেত্রেই নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উলটো ছিল অর্থাৎ র্যাম্সিই নূবিয়ান ও টার্কির
হিটাইটদের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন একেই বলে প্রোগোগাণ্ডা। এই মন্দিরটিকে এমনভাবে
বানানো হয়েছিল যে বছরে দুবার অর্থাৎ বাইশে ফেব্রুয়ারী ও বাইশে অক্টোবর সূর্যের আলো
এই ঘরের অন্ধকার ভেদ করে সোজাসুজি র্যাম্সির মুখে গিয়ে যেন পড়ে। এই দুদিনের
মধ্যে একদিন ওনার জন্মদিন আর অন্যদিন উনি রাজত্ব পেয়েছিলেন। হাজার হাজার বছর আগের
ইজিপসিয়ানদের ইঞ্জিনিয়ারিং ও অ্যাস্ট্রোনমির জ্ঞানের পরিধি দেখে আজও যেন বাক্রোধ
হয়ে যায়। তাই তারা কিভাবে এতসব অসাধ্য সাধন করেছিলেন সেই গবেষণায় না গিয়ে
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমিও মনে মনে বলে উঠলাম ‘-সিন্ধুরে তাকায়ে দেখো, মরিও না
সেঁচে।‘
আবুসিম্বল্মকে
বিদায় জানিয়ে আবার লক্সরে ফিরে এলাম, পরের দিনের গন্তব্যস্থল ছিল লাক্সারের কাছেই
‘ভ্যালি অফ্ দ্য কিং’। নীল নদের কাছে এই পাহাড়ি উপত্যকাটি ছিল তখনকার ফ্যারোদের
সমাধিস্থল। মিশরীয়রা মৃত্যুর পরের জীবনে এতটাই বিশ্বাসী ছিল যে, মৃত ফ্যারোদের
মমির সাথে অজস্র জিনিসপত্র, সোনাদানা, খাবার সবই ঘরের ভেতরে পুরে দিত। দৈনন্দিন
জীবনে ফ্যারোর যা লাগতে পারে সে সব জিনিসপত্র এই ঘরগুলিতে রেখে বাইরে থেকে সিল করে
দেওয়া হত। ফ্যারো মারা যাবার পর চল্লিশ দিন ধরে পুরো শরীরটাকে নুনে ঢেকে সব জলীয় বাষ্প
বার করে শুকনো শরীরটিকে সুগন্ধ তেল ও মশলা মাখিয়ে সাদা ফিতে দিয়ে আপাদ মস্তক
মুড়িয়ে দিত অবশ্য তার আগেই হার্ট বাদ দিয়ে শরীরের সমস্ত অর্গানগুলিকে আলাদা জারে
নুনজলে ভিজিয়ে রাখার চল ছিল। সব দেখে ফ্যারোর মুখের সাথে মিল রেখে সোনার মুখোস
দিয়ে মুখটাকে ঢেকে মমির কফিনে শুইয়ে দেওয়া হত। তুতেন খামেনের চেম্বার বাদ দিলে আর
কোনওটাই চোরেদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি। র্যাম্সি বা হাটশেপসুট্-এর মত শক্তিশালী
কয়েকজন ফ্যারোর মমি অক্ষত অবস্থাতে পাওয়া গেলেও তাদের সাথে পুঁতা ধনসম্পত্তি সবই
অদৃশ্য হয়ে যায়। এই বিশাল পাথুরে ভূখণ্ডে হাওয়ার্ড কার্টার কিভাবে তুতেন খামেনের
সমাধি আবিষ্কার করেছিলেন তা ভগবানই জানেন অর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে চোরে যা
পারেনি উনি তাই পেরেছিলেন। আমরা অনেক চেম্বারেই ঢুকতে পারিনি, কারণ মানুষের
নিশ্বাসে পেষ্টিং নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর কাছেই আর একটি দর্শনীয় স্থান হল
ইতিহাসের সব থেকে পরিচিত মহিলা ফ্যারো ‘হাটসেপ্সুট’-এর মন্দির। স্বামী টাট্মোস
মারা গেলে খৃষ্টপূর্ব চোদ্দশো ঊনআশিতে উনি নিজেই নিজেকে ফ্যারো বলে ঘোষণা করে
সিংহাসনে বসে যান। শুধু তাই নয় পাছে লোকে মহিলা বলে না মানে উনি নকল দাড়ি লাগিয়ে
ছেলেদের মত পোষাক পরে প্রায় বাইশ বছর রাজত্ব চালিয়ে গেছেন। ব্যবসা বাণিজ্যের
ভিত্তিতে এত টাকা করেছিলেন যে তার নিদর্শন স্বরূপ বহু স্মারক স্তম্ভ উনি ইজিপ্টের
বহু জায়গায় রেখে গেছেন। তবে সব থেকে সুন্দর হল
আমুন দেবতার নামে উৎসর্গ করা এই মন্দির। সারি সারি
পিলার দেওয়া তিনটে স্তরে তৈরী এই মন্দিরটি এখনও এত সুন্দরভাবে রাখা আছে যে কে বলবে
এর বয়স সাড়ে তিন হাজার বছর। শোনা যায় এই সাতানব্বই ফিট উঁচু মন্দিরটির প্রতিটি
স্তরই সুন্দর স্ট্যাচু ও ফুল গাছ দিয়ে সাজানো থাকত তাই প্রাচীন মিশরে এটি এক
অতুলনীয় মন্দির বলে খ্যাত ছিল।
লাক্সার
থেকে আবার কায়রোতে ফিরে এলাম, কারণ পরের দিন রাতেই ইজিপ্ট ছেড়ে যাওয়ার পালা। কেন
জানি না বারবার মনে হচ্ছিল হয়ত আমি আর কোনওদিন ইজিপ্ট আসবো না। তাই শেষবারের মত আর একবার স্পিংস্ ও পিরামিডকে দেখে আসি। তাদের দিকে
তাকিয়ে মনে হয়েছিল কত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে সাড়ে চার হাজার বছর ধরে এরা
দাঁড়িয়ে আছে যাদের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’,
‘জ্যুলিয়াস সীজার’ ও ‘নেপোলিয়ান বোনাপার্টে’র মত যোদ্ধারাও হয়ত কিছুক্ষণের জন্য
যুদ্ধ ভুলে আমার মত অবাক হয়ে তাকিয়ে ভেবেছিল কি করে অত বছর আগে মানুষে এই অসাধ্য
সাধন করেছিল?
ইজিপ্ট
ছাড়ার সময় হয়ে এল কিন্তু মনের কোণে এই পিরামিড, স্পিংস্, আবুসিম্বল ও কর্ণাক
টেম্পিল এমন একটা জায়গা করে নিল যে আজও তাদের স্মৃতিচারণ করতে গেলে মুখে বিস্ময়
ফুটে ওঠে। মনে আছে বিদায় নেবার আগে প্রাচীন মিশরের সেই সব না দেখা নাম না জানা
ইঞ্জিনিয়ার, ভাস্কর ও স্থপতিদের উদ্দেশ্যে মনে মনে সেলাম ঠুকে বলে এসেছিলাম- ‘জিতা
রহ তুমারি কাম’।
----------
লেখিকা পরিচিতি
লেখিকা পরিচিতি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন