কবিরুল ইসলাম কঙ্ক
বাজারের জিনিসপত্রের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জামাইয়ের দাম। ভালো জিনিসপত্রের দর যেমন সবসময়ই বেশি, তেমনি ভালো পাত্রের দাম এখন কম নয়। ভালো পাত্র হাতে রাখতে তাই শুরু হয়েছে বুকিং পদ্ধতি। ধরুন রামবাবুর ছেলে পড়াশোনায় ভালো। জয়েন্টে ভালো র্যাবঙ্ক করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছে। শ্যামবাবুর একটি মেয়ে আছে। মেয়েটি দেখতে ভালো। এবার মাধ্যামিক পরীক্ষা দেবে। শ্যামবাবু অমনি রামবাবুর ছেলেকে বুকড করে ফেললেন। ছেলে পাশ করে আসুক। মেয়েরও তখন বিয়ের বয়স হয়ে যাবে। শ্যামবাবুর একটি বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। রামবাবুও খুশ। কারণ তিনি নগদ কিছু সেলামি পাচ্ছেন। টাকাটা তিনি ব্যবসাতে কাজে লাগাবেন। অথবা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করবেন।
পলাশ আর মল্লিকা দুজন দুজনাকে দারুণ ভালোবাসে। ওদের ভালোবাসাবাসির খবর দুই বাড়িতেই জানে। দুই পরিবারই ওদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারে না। পলাশ এবার এস-এস-সি-র পরীক্ষা পাশ করেছে। সামনেই ইন্টারভিউ। পাড়ার সবাই জানে পলাশ মেধাবী ছেলে। ও ঠিক চাকরির নম্বর লাগিয়ে দেবে। মল্লিকার বাড়ি নরম হল। এমন কী রাস্তায় পলাশের সাথে দেখা হলে মল্লিকার বাবা জিজ্ঞাসা করছেন, 'কী বাবা, তোমার আর দেখা সাক্ষাত পাই না কেন?' মল্লিকার বাবা দূরদর্শী। তিনি জানেন, পলাশ চাকরিটা পেয়ে গেলে তিনি সস্তায় দাও মারতে পারবেন।
সুমন ডাক্তার। ভালো পসার। সুতরাং সুমনের বাড়ির সামনে মেয়ের বাবাদের লম্বা লাইন পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। বিয়ের বাজারে আবার ডাক্তারদের দাম একটু বেশিই। ছেলে কী করে? না, ডাক্তার। এটুকু বলতেই মেয়ের বাবার বুকের ছাতি গর্বে ছ-ইঞ্চি বেড়ে যায়। কিংবা শ্বশুরকুলের কারও অসুখবিসুখ হল। চিন্তা কী? জামাই আছে। বিনা ফি-তে চিকিৎসা। তাই ডাক্তার জামাই যত দর হাঁকুক, মেয়ের বাবারা সহজে পিছুপা হন না। সুমনের ক্ষেত্রে বিপত্তিটা বেশি রকমের। একে ডাক্তার। তার উপরে ভালো পসার। পারিবারিক অবস্থা ভালো। দেখতে ভালো। ব্যবহার ভালো। এলাকাতে প্রতিপত্তিও ভালো। এতগুলো ভালোর প্রতি মেয়ের বাবাদের দুর্বলতাও ইদানীং ভালো যাচ্ছে। তাই রোগীর থেকে এখন বিয়ের সম্বন্ধই বেশি আসছে। সুমনের চেম্বারের সামনে বিশাল লাইন দেখে ভাববেন না যে সবাই রোগী। এদের মধ্যে অনেকেই কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা। কোনো কোনো সময় মেয়ে সমেত বাবারা উপস্থিত থাকেন। মেয়ের বাবারা টোপ ফেলেন কুড়ি-পঁচিশ লাখ দেবেন। গয়না উপহার সামগ্রী আলাদা। এবার অন্য আরেকটি মেয়ের বাবা যখন জানতে পারেন সুমনের দাম পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছে, তখন তিনি গিয়ে দর হাঁকলেন – ‘চল্লিশ লাখ’। তার পরের জন হাঁকলেন – ‘চল্লিশ লাখ প্লাস একটি চার চাকা’।
এভাবে বিয়ের বাজারে সুমনের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। ক্রমশই বেড়ে চলেছে তার দাম। জামাই বুকিং-এর সেনসেক্স এত ঊর্ধ্বগামী হতে পারে, এটা কেউ কখনও ভেবে দেখেছেন? বেচারা ডাক্তার এখন নিলামের দ্রব্য। সরকারি চাকরিজীবী পাত্ররাও নিলামের ভালো দ্রব্য। অন্যান্য পাত্রদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটতে পারে। অর্থাৎ ভালো পাত্র মাত্রই নিলামের সামগ্রী। বেচাকেনার বাজারে বেচারী পাত্রীরা কবে যে ভালো জায়গা করে নেবেন?
বিয়ের বাজারে ভালো জামাইয়ের কদর আছে ঠিকই। সমস্যাটা হল বেকারদের নিয়ে। কোনো মেয়ের বাবাই তাদের পাত্তা দেন না ।বেকারদের প্রতি তারা সম্পূর্ণ উদাসীনই শুধু নন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদম বিরোধীপক্ষ। বিয়ের বাজারে তাই বেকাররা পুরোপুরি বেকার। কিছু করে ফেললে (নিদেন পক্ষে ছোটোখাটো ব্যবসা) কুয়াশা কিছুটা কাটে।এই কিছুর প্রভাবে কিছু কিছু মেয়ের বাবা, অবশ্যই প্রভাবিত হন। তবে তা আগাম বুকিং-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ব্যাপার-স্যাপার বুঝবেন, ছেলের অগ্রগতি-অবনতি লক্ষ্য করবেন, এরপর ভাববেন। তারপর আরও কতগুলো জটিল অধ্যায় পার হওয়ার পরে দেখেশুনে লগ্নি করবেন। যেন শেয়ার ব্যবসায় পুঁজি নিবেশ করছেন।
ওদিকে বেকারদের একমাত্র সম্বল প্রেম। রকবাজি, ক্রিকেট, রাজনীতি, বাড়ির হাজার ঝামেলার মাঝে প্রেম যেন মরুভূমির একপশলা বৃষ্টি। প্রেমের কোলে মাথা দিলে সব সমস্যা পরিপাক হয়ে যায়। প্রেম আবার কখনো কখনো উদ্দীপকের কাজ করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে- বাবু এবং তরুর প্রেম। বাবু মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেকার। স্বভাবতই তরুর বাবার কৃপাদৃষ্টিতে সে পড়ে না। তরুর বাবা কোনো একটা চলনসই জামাই বুক করে ফেললেন। টনক নড়ল বাবুর। হি হ্যাজ টু ডু সামথিং। তার প্রেম কিনা বেহাত হয়ে যাবে? বাবু উঠে পড়ে লাগল এবং কিছু একটা করে ফেলল। এক্ষেত্রে প্রেম হল প্রেরণা। এবার ধরুন তরু ন্যাকা। অর্থাৎ ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে। বাড়িতে বিয়ের কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। বাবুর কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, 'তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো। না হলে আত্মহত্যা করব।' বাবু পড়ল গাড্ডায়। একে টু-পাইস ইনকাম নেই। রাজত্ব চলে বাবার ঘাড়ে পা দিয়ে। ফাঁকা পকেটে বিয়ে? বাড়িতে বউ আনা মানে তো হাতি পোষা। বাড়িতে নির্ঘাত গলা ধাক্কা খেতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার হুমকি দিতেই বাবু তার হাত ধরে ভালোমানুষের মতো সুড়সুড় করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসের দিকে যাবে।
তরুলতার বাবা রেগে যাবেন। ভয়ানক রেগে যাবেন । যতটা না বাবুর উপর রাগবেন, তার থেকে বেশি রাগবেন জামাই বুকিং-এর সুযোগটা হাতছাড়া হওয়ার জন্য। বুঝুন ব্যাপারটা ? জামাই বুকিং-এর বিষয়ে আরও বিস্তর বিবরণ দেওয়া যেতে। ভুরি ভুরি উদাহরণ হাতের কাছে ঘুরঘুর করছে। সব বলতে গেলে মহা-উপন্যাস হয়ে যাবে। তবে এই ঘটনাটি না বলে থাকতে পারছি না। বাদল আমার বাল্যবন্ধু। একসাথে আমাদের পড়াশুনা, বড় হওয়া। গ্রাম থেকে শহরে আমরা একসাথে উচ্চশিক্ষা নিতে গেছি। বাদলের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। কখনো টিউশনি, কখনো দোকানে কাজ করে সে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাত। প্রথম দু-বছর একসাথে থাকলেও, পরে সে আলাদা থাকতো। কোথায় যেন এক ভদ্রলোকের বাড়ি পাহারা দেওয়ার বিনিময়ে সেখানে নাকি বিনাপয়সায় থাকতে পেত। একদিন খুবই অবাক হলাম শুনে যে, বাদল নাকি পিএইচডি করতে বিদেশ যাচ্ছে। পরে সে এসে জানাল, কোনো এক সহৃদয় শ্বশুর তাকে মোটা অঙ্কের টাকা 'ম্যারেজ লোন' হিসাবে দিচ্ছে। বিদেশ থেকে ডিগ্রি লাভ করে এসে ভদ্রলোকটির মেয়ের হাত বাদলকে ধরতে হবে।
বাদল বিদেশে গেল। প্রথম প্রথম বেশ চিঠিপত্র লিখত। পরে তা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তারপরে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বছর পাঁচেক বাদে একটি অনুষ্ঠানে বাদলের সাথে দেখা। পাশে একটি টুকটুকে মেম। বাদলই পরিচয় করিয়ে দিল, 'মাই ওয়াইফ, সিন্ডারেলা।' আমি তো হা হয়ে গেছি। বাদল জানাল - সে এখন বিদেশে চাকুরি করে এবং সেখানেই সেটলড। বিয়েও করেছে বিদেশি মেয়েকে। আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, 'তোর ম্যারেজ লোন?' বাদল মুচকি হেসে বলল, 'শোধ করে দিয়েছি।'
জামাইবুকিং ভালো লাগলো। আপনার এই গল্পটা পড়ে আমার ও বেশ কিছু ঘটনা মনে পড়ছে । ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা রইলো।
উত্তরমুছুন