দীননাথ মণ্ডল
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিকতম কাল পর্যন্ত বাঙালীর সাধনার শ্রেষ্ঠ সম্পদই তাঁর সংগীত। বাঙালীর ধ্যান-ধারণা, সামাজিক আচার-আচরণ, সুখ-দুঃখের অনুভূতি_ এককথায় বাঙালীর চরিত্রকে জানতে হলে সংগীতকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ জানা সম্ভব নয়। বস্ততঃ সংগীতই হল বাংলার সংস্কৃতির প্রাণ।
বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান ও ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিকতার প্রেক্ষাপটে লোক সংস্কৃতিগুলি আবার কিছুটা পৃথক পৃথক। কোথাও কোথাও তা সীমিত ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ‘বোলান গান’ হল এরকম একটি বাংলার লোক সংস্কৃতি। এটা মূলত মুর্শিদাবাদ ও তৎ-সংলগ্ন নদীয়া, বর্ধমান, বীরভূম জেলার কিছু অঞ্চলে চৈত্রমাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে শিবের গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে চৈত্রমাসের ২৭শের রাত থেকে ১লা বৈশাখ পর্যন্ত বোলান গান চলে। আগে একে গাজনের সন্ন্যাসী বা গাজনে বালার গান বলা হত। স্থানীয় লোকেরা একে বলে বোলান বা বুলান গান।
‘বোলান’ কথার অর্থ হল বোল আন্ অর্থাৎ সুর আন্। বোল বা ডাক থেকে বোলান নামকরণ। কেউ মনে করেন ‘বুলা’ থেকে বুলান গান। ‘বুলা’ অর্থাৎ ভ্রমণ। গ্রাম বা পাড়া ঘুরে এ গান গাওয়া হয় বলে একে ‘বুলান’ বলে। অনেকে মনে করেন, মুর্শিদাবাদের রাঢ় অঞ্চলই হল বোলান গানের আদি জন্মক্ষেত্র।
বোলান গানের বিষয় বস্তু আগে পৌরাণিক কাহিনীগুলিকে কেন্দ্র করে গাওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে সে গন্ডী ছাড়িয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। এককথায় সমাজ বিবর্তনের ধারায় তা পরিবর্তনশীল।
বোলান গান কোন শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। এটা মূলত গ্রাম্য অর্ধ-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ওই সম্পর্কিত অভিজ্ঞ ব্যক্তি বিভিন্ন সুর তৈরি করে একটা ঘটনাকে সুন্দরভাবে রচনা করেন। এদের ছড়াদার বলে। মানুষের জীবনে হাঁসি-কান্না, সুখ-দুঃখের ঘটনা এর উপজীব্য।
বোলান গানে নারী চরিত্রের অভিনয় করেন পুরুষেরাই। নারীর বিভিন্ন অলংকার, সাজসজ্জা প’রে পুরুষরাই নারী সাজে। বোলানের ভাষায় এদের ‘ছোকরা’ বলে। কারণ অভিনয়ের পরে এরা ধূমপান করে। সাধারণ মানুষ তখন বুঝতে পারে এরা মেয়ে নয়, ছেলে বা ছোকরা।
ঘটনার মধ্যে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে গানও হয়। অভিনয়কারী যে গানটি গায় সেই গানের অন্ত্যমিল যুক্ত ধুয়া গানটি আসরে বসে থাকা অন্যান্য শিল্পীরা সমবেতভাবে গায়। এদেরকে দোহার বলে।
বোলান গানে নানান বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন- ঢোলক, হারমোনিয়াম, জুরি, ঝাঁঝর, করতাল, ঝুমঝুমি, পাকোয়াজ, তবলা, ফুলেট বাঁশি, এমনকি আধুনিক কালের বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করা হয়। সুরের সঙ্গে বাজনার তাল আসর সব সময় মাতিয়ে রাখে।
পাড়ার কোন এক বা দু’জনের উদ্দ্যোগে বা নেতৃত্বে কিছু ছেলে নিয়ে একটি দল বা টিম গঠণ করা হয়। তারপর একটি পালা চারণ কবি বা ছড়াদারের কাছ থেকে কিছু টাকার বিনিময়ে তৈরি করে করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘বই বাঁধা’। এরপর পালা করে রাতে প্রতিদিন এক দু’মাস রিহাসেল বা রেওয়াজ করা হয়। অভিনয়ের চরিত্র অনুযায়ী পোষাক ও অন্যান্য জিনিসপত্র ভাড়া করা হয়। মেক আপের জন্য রং ও চুল কেনা হয়। তারপর মাইক ও গাড়ি নিয়ে ২৭শে চৈত্র রাতে বাড়ি থেকে বের হয়। যেখানে গাজন উৎসব হয় সেই শিব মন্দির বা গাজন তলায় টাকার বিনিময়ে গেয়ে বেড়ান। চারদিনের অর্জিত অর্থ খরচ বাদে বিশেষ কিছু লাভ হয় না। তবে এটা করে থাকে নিছক আনন্দ লাভের জন্য।
সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালীর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য আনন্দ লাভ ও অপরকে আনন্দ দান। তাই বছরের শেষে সংকীর্ণ অর্থের স্বার্থ ভুলে বসন্তের শেষ ছোঁয়াটুকু বুকে নিয়ে আরেকটা নতুন বছরকে স্বাগত জানায় আসরে আসরে বোলান গানে মাধ্যমে। আর এখানেই বাঙালীর সংস্কৃতি চিরন্তন।
বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান ও ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিকতার প্রেক্ষাপটে লোক সংস্কৃতিগুলি আবার কিছুটা পৃথক পৃথক। কোথাও কোথাও তা সীমিত ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ‘বোলান গান’ হল এরকম একটি বাংলার লোক সংস্কৃতি। এটা মূলত মুর্শিদাবাদ ও তৎ-সংলগ্ন নদীয়া, বর্ধমান, বীরভূম জেলার কিছু অঞ্চলে চৈত্রমাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে শিবের গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে চৈত্রমাসের ২৭শের রাত থেকে ১লা বৈশাখ পর্যন্ত বোলান গান চলে। আগে একে গাজনের সন্ন্যাসী বা গাজনে বালার গান বলা হত। স্থানীয় লোকেরা একে বলে বোলান বা বুলান গান।
‘বোলান’ কথার অর্থ হল বোল আন্ অর্থাৎ সুর আন্। বোল বা ডাক থেকে বোলান নামকরণ। কেউ মনে করেন ‘বুলা’ থেকে বুলান গান। ‘বুলা’ অর্থাৎ ভ্রমণ। গ্রাম বা পাড়া ঘুরে এ গান গাওয়া হয় বলে একে ‘বুলান’ বলে। অনেকে মনে করেন, মুর্শিদাবাদের রাঢ় অঞ্চলই হল বোলান গানের আদি জন্মক্ষেত্র।
বোলান গানের বিষয় বস্তু আগে পৌরাণিক কাহিনীগুলিকে কেন্দ্র করে গাওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে সে গন্ডী ছাড়িয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। এককথায় সমাজ বিবর্তনের ধারায় তা পরিবর্তনশীল।
বোলান গান কোন শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। এটা মূলত গ্রাম্য অর্ধ-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ওই সম্পর্কিত অভিজ্ঞ ব্যক্তি বিভিন্ন সুর তৈরি করে একটা ঘটনাকে সুন্দরভাবে রচনা করেন। এদের ছড়াদার বলে। মানুষের জীবনে হাঁসি-কান্না, সুখ-দুঃখের ঘটনা এর উপজীব্য।
বোলান গানে নারী চরিত্রের অভিনয় করেন পুরুষেরাই। নারীর বিভিন্ন অলংকার, সাজসজ্জা প’রে পুরুষরাই নারী সাজে। বোলানের ভাষায় এদের ‘ছোকরা’ বলে। কারণ অভিনয়ের পরে এরা ধূমপান করে। সাধারণ মানুষ তখন বুঝতে পারে এরা মেয়ে নয়, ছেলে বা ছোকরা।
ঘটনার মধ্যে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে গানও হয়। অভিনয়কারী যে গানটি গায় সেই গানের অন্ত্যমিল যুক্ত ধুয়া গানটি আসরে বসে থাকা অন্যান্য শিল্পীরা সমবেতভাবে গায়। এদেরকে দোহার বলে।
বোলান গানে নানান বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন- ঢোলক, হারমোনিয়াম, জুরি, ঝাঁঝর, করতাল, ঝুমঝুমি, পাকোয়াজ, তবলা, ফুলেট বাঁশি, এমনকি আধুনিক কালের বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করা হয়। সুরের সঙ্গে বাজনার তাল আসর সব সময় মাতিয়ে রাখে।
পাড়ার কোন এক বা দু’জনের উদ্দ্যোগে বা নেতৃত্বে কিছু ছেলে নিয়ে একটি দল বা টিম গঠণ করা হয়। তারপর একটি পালা চারণ কবি বা ছড়াদারের কাছ থেকে কিছু টাকার বিনিময়ে তৈরি করে করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘বই বাঁধা’। এরপর পালা করে রাতে প্রতিদিন এক দু’মাস রিহাসেল বা রেওয়াজ করা হয়। অভিনয়ের চরিত্র অনুযায়ী পোষাক ও অন্যান্য জিনিসপত্র ভাড়া করা হয়। মেক আপের জন্য রং ও চুল কেনা হয়। তারপর মাইক ও গাড়ি নিয়ে ২৭শে চৈত্র রাতে বাড়ি থেকে বের হয়। যেখানে গাজন উৎসব হয় সেই শিব মন্দির বা গাজন তলায় টাকার বিনিময়ে গেয়ে বেড়ান। চারদিনের অর্জিত অর্থ খরচ বাদে বিশেষ কিছু লাভ হয় না। তবে এটা করে থাকে নিছক আনন্দ লাভের জন্য।
সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালীর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য আনন্দ লাভ ও অপরকে আনন্দ দান। তাই বছরের শেষে সংকীর্ণ অর্থের স্বার্থ ভুলে বসন্তের শেষ ছোঁয়াটুকু বুকে নিয়ে আরেকটা নতুন বছরকে স্বাগত জানায় আসরে আসরে বোলান গানে মাধ্যমে। আর এখানেই বাঙালীর সংস্কৃতি চিরন্তন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন