মাস্টারমশাই

   কবিরুল ইসলাম কঙ্ক


    পারতপক্ষে কেউ তার সামনে যায় না খুব দরকার হলে দূর থেকেই কাজ সেরে নেয় মেজাজি কিংবা বদরাগী বলতে  যা বোঝায় তিনি হচ্ছেন তাই  কারও গাফিলতি বিন্দুমাত্র বরদাস্ত করেন না তিনি সুতরাং সবাই ত্রস্ত থাকে তাঁর নজরদারিতে কোথাও পান থেকে চুন খসার উপায় নেই  তিনি ইংরেজির শিক্ষক অভয়বাবু ছাত্ররা তো বটেই বাকি শিক্ষকেরা, এমন কী হেডমাস্টারও তাঁকে ভয় করেন কারণ তাঁর ষ্পস্টবাদিতা সত্য এবং ন্যায়কে তিনি সামনে তুলে ধরতে পিছপা হন না। 
     ইংরেজি একে বিদেশি ভাষা, তাতে আবার ছেলেপিলেদের অনীহা - দুই মিলে পাঠ-কে দুর্বল করে দেয়শ ফলে ক্লাসে যে তার প্রতিফলন ঘটবে তা বলাইবাহুল্য একে ইংরেজির ভয় তার উপরে অভয়বাবুর উপস্থিতি ছাত্রদের ভয় আরও বাড়িয়ে দিত তারা চেষ্টা করতো অন্য পড়া না হোক ইংরেজি পড়াটা করে আসতে কারণ তারা জানতো অভয়বাবু একেবারে হৃদয়হীন পড়া না পারলে হাড়মাস এক জায়গায় রাখবেন না যারা পড়া একেবারেই পারতো না তারা ক্লাসে থাকতো না পাশের আমবাগানে ওই পিরিয়ডটা কাটিয়ে আসতো
     ছাত্রদের এই ভয়ের কথা অভিভাবকরা জানতেন ছাত্রদের মারধর করা আইন বিরুদ্ধ কাজ সেটাও তারা জানেন কিন্তু ডানপিটে ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করার ওষুধ যে অভয়মাস্টার তাতে সন্দেহ নেই তাই তারা অভয়মাস্টারকে অভয় দেন, "মাস্টার, মেরে হোক ধরে হোক আমার ছেলেটাকে একটু মানুষ করে দেন "অভিভাবকদের এমন সমর্থন পেয়ে অভয়বাবু হয়ে উঠেছিলেন আরও ভয়ংকর সুতরাং ছাত্ররা তো বটেই অন্য শিক্ষকেরাও তাঁকে বিশেষ ঘাঁটাতেন না
    এহেন ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই মুষড়ে থাকতেন কেউ কোনদিন তাঁর কোমল হৃদয়ের স্পর্শ পেয়েছে কিনা সন্দেহ এ নিয়ে চর্চাও কম নয় সবাই জানেন অভয়বাবুর হৃদয়ে কোমলতা বলে কোনো বস্তু নেই মাস্টারমশাই নিজেও এব্যাপারটা অনুভব করেন কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না তিনি যেমন ছিলেন তেমনই রয়ে গেছেন
    সেবার বর্ষায় খুব বৃষ্টি বৃষ্টির দাপটে ঘর থেকে বের হওয়াই দায় পথে ঘাটে জল জমে গেছে মাঠে ধানের শীষটুকু শুধু দেখা যায় গ্রামের পাশে নদীর বাঁধের অবস্থা ভালো নয় নদীর জলের তোড়ে বাঁধের কিছু কিছু জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে বাঁধ ভেঙে গেলে বন্যা অবশ্যাম্ভাবী গ্রামের মানুষজন খুব দুশ্চিন্তায় আছে বিগত বন্যার অভিজ্ঞতা তাদের মোটেই ভালো না
    অবশেষে সবার আশংকা  সত্যি করে বন্যা এল গ্রামের মানুষদের দুর্দশার শেষ নেই ক্রমাগত বৃষ্টি বন্যাকে আরও ঘোরালো করে তুললো মানুষজন সাতদিন ধরে ঘরবন্দি সবার ঘরেই দেখা দিল খাদ্যাভাব মজুত খাদ্য শেষ হতেই মানুষেরা জলের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল খাবারের সন্ধানে বড়রা খিদে সহ্য করতে পারলেও ছোটরা পারে না নিজের ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তারা আর ঘরে থাকতে পারল না কিন্তু বেরিয়েই কিছু  হল কই ? আশেপাশের দশ বারোটি গাঁ ভেসে গেছে সবার ঘরেই এক অবস্থা গ্রামের যারা একটু অবস্থাপন্ন লোক তাদের ঘরে টাকা আছে কিন্তু খাবার নেই এ জলের রাজ্যে টাকা দিয়ে কী হবেদরকার তো  তো খাবার
    গ্রামের মধ্যে অভয়মাস্টারের বাড়ি একটু উঁচু জায়গায় বন্যার জল সবার বাড়িতে ঢুকলেও মাস্টারের বাড়িতে ঢুকতে পারেনি বন্যাতে স্কুল বন্ধ বাড়িতেও কাজকর্ম কিছু নেই মাস্টারমশাই দুপুরে বারান্দায় চেয়ারে বসে একটা উপন্যাস পড়ছিলেন বারান্দার নীচে রাস্তা রাস্তা এখন জলে ভর্তি রাস্তার জল ঠেলে আসছিল বারো-চৌদ্দজনের একটি দল পাংশু তাদের মুখ বোঝা যাচ্ছে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তারা বেরিয়েছিল, সে উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়নি তারা বারান্দার কাছে আসতেই অভয়বাবু জলদগম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমাদের কী ব্যাপার ? "তারা তাদের কথা বলল  গ্রামের মানুষের দুর্দশার কথা শুনে মাস্টারমশাই একটু ভাবলেন তার ঘরে যথেষ্ট চাল-ডাল-তেল  মজুত আছে সবই নিজের জমি থেকে আসে বাড়ির পিছনে সব্জির জমিতেও জল ওঠেনি তিনি লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন, "তোমরা এক কাজ করো চাল ডাল আমার বাড়িতে প্রচুর আছে সব্জিও পাওয়া যাবে এখানেই খিচুড়ি রান্না আরম্ভ  করো আর গ্রামে সবার বাড়িতে খবর দাও এখানেই সবাই খেয়ে যাবে "মাস্টারের কথা শুনে অভুক্ত মানুষগুলো হাতে যেন স্বর্গ পেল তারা মহানন্দে রান্নার কাজে লেগে পড়ল

    রান্না শেষ হতে বেলা প্রায় গড়িয়ে গেছে অভয় মাস্টারের বাড়ির উঠোনে প্রায় তিনশো লোকের পাত পড়েছে মা-বাবাদের সাথে অনেক ছাত্রও আছে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে তারা বেশ আড়ষ্ট মাস্টারমশাই হাসিমুখে সবার খাওয়াদাওয়া তদারকি করছেন মাস্টারমশাইয়ের মুখে বিরল হাসি দেখে ছাত্ররা অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে খাচ্ছে অভয়মাস্টার সবার উদ্দেশ্যে বললেন, "সবাই পেট পুরে খাবেন যতদিন জল নেমে না যায় আমার বাড়িতে সবার নিমন্ত্রণ রইলো"




লেখক পরিচিতি


জন্মস্থানঃ দেবকুন্ডু, মুর্শিদাবাদ জেলা, পশ্চিমবঙ্গ ।

পেশাঃ শিক্ষকতা ।

সম্পাদকঃ 'প্রতিচ্ছবি' সাহিত্য পত্রিকা।

প্রকাশিত বইঃ যদি আগুন জ্বালাই (২০০৪), স্পর্ধিত উচ্চারণ (২০০৫), সূর্য ছুঁলে (২০০৬), সে (২০০৬), বাংলা শায়েরী (২০০৭), একা আছি নির্বাসনে (২০০৯), অন্য পড়া বিজ্ঞানের ছড়া (২০০৯), সন্দেহজনক কথাবার্তা (২০১০), কলেজ জীবনের নোটস (২০১৩), কবিতার অ্যালবামে পাঁচ (সংকলন), এক আকাশ ছড়া (সম্পাদিত)।

পুরস্কার/সম্মাননাঃ 'সাহিত্য স্বর্ণরত্ন' (ওয়ার্ল্ড ফোরাম অফ জার্নালিস্ট এন্ড রাইটার্স), 'আব্দুল করিম স্মৃতি পুরস্কার' (ইদানীং সাহিত্য পত্রিকা), 'কবি সম্মাননা' (কলকাতা ইউনাইটেড কালচারাল সোসাইটি) ।






শেয়ার করুন

1 টি মন্তব্য:

  1. আমার জীবনেও এসেছিলেন এমনই এক মাস্টার মশাই। আপাতঃ গাম্ভীর্যের মধ্যে ভালোবাসার ফল্গু ধারা বয়ে চলে তাঁদের ও অন্তরে।

    উত্তরমুছুন