ফাল্গুনী মুখ্যোপাধ্যায়
কাহিনীর সবটাই ডাক্তার নন্দীর কাছ থেকে শোনা। ডাক্তার ভোলানাথ নন্দী- বছর পাঁচেক হবে বোধ হয়, এপাড়ায় ফ্ল্যাট নিয়েছেন। মফঃস্বলের এই আধা গ্রাম- আধা শহরের আটপৌরে লোকজনের মাঝে ডাক্তার নন্দী বেশ বড় মাপের লোকই বলতে হবে। আধা গ্রাম হলে কি হবে, বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি গজাতে তো বাধা নেই, গজিয়ে উঠছেও অনেক। ডাঃ নন্দী, শুনেছি মনরোগের চিকিৎসক, তবে এপাড়ায় তার কোন চেম্বার নেই, থাকার কোন কারণও নেই। বেশ রাশভারি মানুষ, শুনেছি আগে দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে না কোথায় থাকতেন।
গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ডাক্তার নন্দী, পাড়ায় বেশি মেলামেশা ক’রতেন না, মানে পাড়ায় দুর্গা পুজো বা কোন অনুষ্ঠানে তাকে খুব বেশি দেখা যেত না, তবে আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। কেন জানিনা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন, গল্প করতেন, আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কিন্তু কোনদিন তাঁর পারিবারিক ব্যাপারে কোন কথা বলতেন না, শুধু জেনেছিলাম তাঁর একমাত্র ছেলে, আমার বয়সী বাইরে ডাক্তারী পড়ছে। আমি একটু আধটু নাটক-থিয়েটার করি আর সেই সূত্রেই ডাক্তার নন্দীর সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার নন্দী তখন এপাড়ায় নতুন এসেছেন। আগের দিন পাড়ার রবীন্দ্র ভবনে আমার লেখা একটা নাটক অভিনীত হয়েছিল। আমি সকালে রাস্তার মোড়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম, ডাক্তার বাবু রিকশতে আসছিলেন- বোধহয় বাজার করে ফিরছিলেন। রিকশ থামিয়ে কাছে এলেন, বললেন ‘কাল তোমার নাটকটা দেখলাম, একদিন এসো আলাপ করবো’। আমি অবাক হলাম, আজকাল বাড়িতে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড দিয়ে এলেও টেলি সিরিয়াল ছেড়ে লোকে নাটক দেখতে আসে না, আর ডাক্তার বাবুর মত ব্যস্ত লোক নিজ থেকে আমার নাটকটা দেখতে এসেছিলেন! ডাক্তার বাবু বলেছিলেন ‘এমনিতে নাটক-টাটক দেখার সময় পাই না, কিন্তু তোমার নাটকটার- কি যেন নাম- ‘এখন অসুখ’ তাইতো’? আমি ঘাড় নাড়লাম, ডাক্তার বাবু বলেছিলেন ‘হ্যা, ওই নামটা আমাকে আকর্ষণ করলো, আসলে আমি তো ডাক্তার, তাই ভাবলাম দেখি নাট্যকার কোন অসুখের কি ডায়াগনোসিস করেছে’।
অবাক হলাম, আবার ভালোও লাগলো। নাটকটা ছিল এক প্রবীণ দম্পতির আত্মযন্ত্রণার ছবি। তাদের একমাত্র সন্তান বিদেশে চাকুরী করতে গিয়ে সেখানেই থেকে গেছে। বিয়ে করার পর গত পনেরো বছরে একদিনের জন্যও বাবা মাকে দেখতে আসেনি। টাকা পাঠায়, ফোন করে, খবর নেয় কিন্তু একদিনের জন্যেও তার সময় কিংবা ইচ্ছা হয়না। এদিকে মা’র মৃত্যু হয়, খবর যায়। ছেলে আসবে বলে বৃদ্ধ বাবা একদিন মৃতদেহ রেখে দেন, ছেলে তার গর্ভধারিনীকে দেখতে আসবে। কোন ফ্লাইটে আসবে ছেলে তাও জানিয়েছে। বাবা পথ চেয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ মুহুর্তে ছেলের বদলে আসে একটা ফোন- ‘বাবা, কাজের চাপে যেতে পারছি না, টিকিট ক্যান্সেল করেছি’।
তবে কি ডাক্তার বাবু আমার নাটকে নিজেকে খুঁজতে চেয়েছিলেন? ভাবলাম। কিন্তু ডাক্তার বাবুর ছেলে তো বিদেশে পড়ে না। সেদিন ডাক্তার বাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম, পরে আরো অনেকবার। ডাক্তার বাবুও আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলেন। একদিন ডাক্তার বাবুকে বললাম- ‘ডাক্তার বাবু, আপনি তো মনের নানান জটিল রোগের চিকিৎসা করেন, আপনার কেস স্টাডি থাকে একটা গল্প বলুন না, যা থেকে একটা নতুন নাটক লিখতে পারি’। ডাক্তার বাবু মিনিট খানেক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা পুরোনো খবরের কাগজ আমাকে দিয়ে বললেন, পড়ো। দেখলাম কাগজের তারিখটা ১৬ই এপ্রিল ২০০২। একটা সংবাদে দাগ দেওয়া রয়েছে, পড়লাম। ক্লাস সেভেনের একটা ছেলে তার সহপাঠীকে চেয়ারে বেঁধে গলা টিপে খুন করেছে। যাকে মেরেছে সে ওর স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিল, খুনি ছেলেটিও খুব মেধাবি ছাত্র ছিল, তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এইটুকুই মাত্র ছিল খবরটা। ঘটনাটা আমি জানতাম, কাগজে দেখেছিলাম, তখন সবেমাত্র মাধ্যামিক পাশ করেছি, তারপর ভুলেও গেছি। এমন ঘটনা এতো ঘটেছে যে তা জেনে কেউই আর বিচলিত হয়না, আমিও হইনি। আমি বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার বাবু, এইটুকু মাত্র কাহিনি নিয়ে নাটক হবে কি করে? নাটকীয়তা কোথায়’? ডাক্তার নন্দী মনে হলো সামান্য উত্তেজিত হলেন ‘কি বলছো তুমি নাট্যকার, নাটকীয়তা নেই? একটা এগারো বছরের নিষ্পাপ শিশু তার সহপাঠীকে খুন করলো, নাটকীয়তা নেই বলছ’? আমি বললাম ‘না, মানে পরের ঘটনা গুলো না জানলে...’, কথাটা শেষ হল হল’না, ডাক্তার বাবু বললেন ‘বলবো, সব বলবো, তবে আজ নয়’, এই একটি মাত্র কেসই আমি স্টাডি করছি বারো বছর ধরে’।
সেদিন চলে এলাম, অনেকগুলো ছবি মনে ভীড় করলো। কি হ’ল ছেলেটির, সে কি পেশাদার অপরাধী হ’য়ে গেল? তার মা, তাঁরই বা কি পরিনতি হলো? আবার নিজেকে তিরস্কার করলাম, দূর! আমি কি জম্পেট টেলি সিরিয়াল লিখছি নাকি! আমার মস্তিষ্ক জুড়ে ঐ কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সমাজের এ কোন গভীর অসুখ! কার পাপে একটা নিষ্পাপ শিশু খুনি হয়ে যায়! ক’দিন পরে ডাক্তার বাবুর ডাক পেয়ে গেলাম। ‘তোমাকে খুব দরকার, আমার একটা উপকার করতে হবে, আমার কাজে লাগবে তোমার সাহায্য’। আমি বুঝতে পারলাম না আমার মত একটা থিয়েটার করা তরুণ অত বড় মাপের চিকিৎসকের কি কাজে লাগবো। বললেন ‘তোমাকে একটু অভিনয় করতে হবে, দশ পনের মিনিট। আমার চিকিৎসার এটাই শেষ ধাপ হতে পারে, আমি নিশ্চিত এই শেষ ধাপটা পেরোলে রোগী হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে, ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাবে’। আমি বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার বাবু, আমার নাটকের কাহিনিটার কী হবে, আজকে বলবেন না’? বললেন ‘হ্যা হ্যা আজই বলব, মাত্র আট-দশ মিনিট, আমাকে আমার চিকিৎসার শেষ ধাপটা পেরোতে দাও’।
আমি সম্মোহিতের মত শুনে যাচ্ছিলাম, ডাক্তার বাবু আমাকে দিয়ে কি করতে চাইছেন? ডাক্তার বাবুর কথায় হুঁশ ফিরল, ব’ললেন, ‘শোন, আমি একজনকে নিয়ে আসছি, তোমার কাকিমার যা বয়স হওয়া উচিত সেই বয়সী, তুমি তার ছেলের বন্ধু, আজই দেরাদুন থেকে এসেছ’। একটা সাদা খাম আমার পকেটে দিয়ে বললেন ‘চিঠিটা ওর হাতে দেবে, কোন প্রশ্ন করলে ইতিবাচক উত্তর দেবে, হ্যা, বলা হয়নি ও কিন্তু চোখে দেখতে পাই না, ঠিক আছে? আমি আসছি’। এক সুদর্শনা মহিলাকে নিয়ে ভেতরে এলেন, সত্যিই কাকিমা বলে ডাকতে ইচ্ছা হ’চ্ছিল- অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী চেহেরা। ডাক্তার বাবু বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন ‘দেখ সুপর্ণা, শুভর বন্ধু এসেছে, পাঠিয়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে’। আমি নিপুন অভিনেতার মত প্রণাম করলাম, উনি বললেন, ‘তুমি শুভর বন্ধু? শুভ কেমন আছে? পরীক্ষাতে ফার্স্ট হয়েছে তো?’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ কাকিমা প্রত্যেক বছর ওই তো ফার্স্ট হয়, এবারও হয়েছে, ও ছাড়া আর কে ফার্স্ট হবে’? উনি বললেন ‘ঠিক বলেছ, জান কত বকতাম- বলতাম তোমাকে সমস্ত পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে, ও কথা রেখেছে। কিন্তু কবে আসবে শুভ কিছু বলেনি’? স্টেজে মেক আপ করার মত আমি বললাম ‘এই তো সামনের পূজোর ছুটিতেই আসবে বলছিল, আমাকে একটা চিঠিও দিয়েছে’ বলে পকেট থেকে একটা সাদা খাম উনার হাতে দিলাম। বললেন ‘শুভ চিঠি দিয়েছে? ওতে লেখা আছে পূজোর ছুটিতে আসবে?’ বললাম ‘হ্যাঁ সেরকমই তো বললো’। উনি চিঠিটা বুকে চেপে ধরলেন। আমি মঞ্চে অভিনয় করি, কিন্তু ছেলের জন্য দৃষ্টিহীন মা’র ভালোবাসার এমন প্রকাশ আমাকেও দুর্বল করে দিল বইকি! আমাকে আর বেশিক্ষণ অভিনয় করতে হ’লনা, ডাক্তার নন্দী বললেন ‘এবার তুমি ভেতরে যাও সুপর্ণা। শুভর বন্ধু এখনো নিজের বাড়িতেই যায়নি, অনেক দূর যেতে হবে’। উনি বললেন ‘যাও বাবা, শোন, তুমি ফিরে যাবার আগে, একবার দেখা করে যেও, শুভর জন্য আলুর চিপস কিনে রাখবো, নিয়ে যেও, ও আলুর চিপস খেতে খুব ভালোবাসে’। ডাক্তার বাবু উনাকে ভেতরে রেখে এলেন।
আমি বুঝলাম আজকে আর গল্পের শেষ শোনা হবে না। বললাম, ডাক্তার বাবু আজ তবে আমি যাই। উনি বললেন, ‘আরে, বোস বোস গল্পের বাকিটা শুনবে না’? আমি ব’সলাম। ডাক্তার বাবু ব’লে চললেন। ‘ছেলেটা পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল, কিন্তু শুধু ভালো হ’লেই তো হবে না, ওর মা চাইতো ওকে ফার্স্ট হ’তে হবে প্রতিটি পরীক্ষায়, সব কিছুতেই। খেলা ধুলো ছবি আঁকা সব বন্ধ- শুধু দৌড় ফার্স্ট হওয়ার জন্য। সেবার ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষায় ছেলেটি সেকেন্ড হয়েছিল। ওর মা খুব বকাবকি করেছিল, গল্পের বই, ছবি আঁকা সরঞ্জাম- সব ফেলে দিল, শুধু স্কুলের বই পড়তেই হবে আর ফার্স্ট হ’তে হবে। ছেলেটির মা’র এই বিকৃত মানসিকতার দাবি মেটানোর চাপ ওইটুকু ছেলে সামলাবে কি করে ? তাই তার সহপাঠী যে বারবার ফার্স্ট হ’ত তাকেই সরিয়ে দিল গলা টিপে খুন করে’। আমি শুধু বললাম ‘তারপর’? ডাক্তার নন্দী ব’লে চললেন ‘জুভেনাইল কোর্টের বিচারে সাজা হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর- সব কথা অকপটে স্বীকার করেছিল বলে। খুব মেধাবী ছিল, সংশোধনাগারে পড়াশোনা ক’রে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে, তারপর জয়েন্ট এনট্রান্সে সফল হয়ে এখন ডাক্তারি পড়ছে। এই বারোটি বছর ছেলেটি তার মাকে দেখেনি। পূজোর ছুটিতেই যদি আসে...’। আর বললেন না। দেখলাম, আপাত কঠিন মনের ডাক্তারের চোখ দুটো জলে চিক চিক করছে।
জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি সেই ছেলেটারও মানসিক চিকিৎসা করেছিলেন? বললেন, ‘না, তার তো চিকিৎসার দরকার ছিল’না, চিকিৎসার দরকার ছিল তার মা’র, বারো বছর ধরে আমি তারই চিকিৎসা করে চলেছি, ক্রমেই সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে’।
‘আর সেই ছেলেটি’? আমি কৌতুহল চাপতে পারলাম না। ডাক্তার নন্দী আমার মুখের দিকে তাকালেন, বললেন ‘সেই ছেলেটিই শুভ- শুভঙ্কর, একটু আগে তুমি যার বন্ধুর অভিনয় করলে। শুভঙ্কর আমারই ছেলে’। এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা আমাকে আচ্ছন্ন ক’রলো। শুধু ডাক্তার বাবুর কথা শুনে চলেছি- ‘আর যাকে তুনি শুভঙ্করের বন্ধু হয়ে প্রণাম ক’রলে সে শুভঙ্করেরই মা, ১২ বছর ধরে আমি যার মনের জট খোলার চেষ্টা ক’রে চলেছি’। আমি কয়েক মিনিট কোন কথা ব’লতে পারলাম না। ডাক্তার বাবুর কথায় ঘোর কাটলো। ‘এবার তবে এসো, অনেকক্ষণ তোমাকে আটকে রাখলাম’। আমি উঠলাম, শুধু অস্ফূট স্বরে বললাম, ‘কাকিমা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে উঠবেন তো’?
ডাক্তার বাবু ব’ললেন ‘হ্যাঁ, আশাতো করছি, শুভ এসে সম্পূর্ণ সুস্থ মাকে দেখতে পাবে, তবে...’ ভারি হয়ে আসা কন্ঠে বললেন, ‘দুঃখ একটা থাকবে যে ছেলেকে সে সে দেখতে পাবে না, স্পর্শ ক’রতে পারবে মাত্র। মাঝে মাঝে এসো, শুভর বন্ধু হয়েই এস, তোমাকে স্পর্শ ক’রে হয়তো তোমার কাকিমা আর একটু তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবে। আর হ্যাঁ, নাটকটা লেখা হলে আমাকে পড়াবে’। ‘আসবো, নিশ্চয় আসবো’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় বেরিয়ে নিজেকে ব’ললাম- লিখবো, নাটকটা লিখবো। কিন্তু কাকে নিয়ে? সমাজের গভীরতর অসুখের বিরুদ্ধে ডাক্তার নন্দীর নিঃশব্দ সংগ্রাম, না কি সেই গভীর অসুখের মুখে লাথি মেরে নিজের সহপাঠীকে খুন করা সেই ছেলেটির ডাক্তার শুভঙ্কর নন্দী হয়ে ওঠার কথা?
গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ডাক্তার নন্দী, পাড়ায় বেশি মেলামেশা ক’রতেন না, মানে পাড়ায় দুর্গা পুজো বা কোন অনুষ্ঠানে তাকে খুব বেশি দেখা যেত না, তবে আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। কেন জানিনা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন, গল্প করতেন, আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কিন্তু কোনদিন তাঁর পারিবারিক ব্যাপারে কোন কথা বলতেন না, শুধু জেনেছিলাম তাঁর একমাত্র ছেলে, আমার বয়সী বাইরে ডাক্তারী পড়ছে। আমি একটু আধটু নাটক-থিয়েটার করি আর সেই সূত্রেই ডাক্তার নন্দীর সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার নন্দী তখন এপাড়ায় নতুন এসেছেন। আগের দিন পাড়ার রবীন্দ্র ভবনে আমার লেখা একটা নাটক অভিনীত হয়েছিল। আমি সকালে রাস্তার মোড়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম, ডাক্তার বাবু রিকশতে আসছিলেন- বোধহয় বাজার করে ফিরছিলেন। রিকশ থামিয়ে কাছে এলেন, বললেন ‘কাল তোমার নাটকটা দেখলাম, একদিন এসো আলাপ করবো’। আমি অবাক হলাম, আজকাল বাড়িতে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড দিয়ে এলেও টেলি সিরিয়াল ছেড়ে লোকে নাটক দেখতে আসে না, আর ডাক্তার বাবুর মত ব্যস্ত লোক নিজ থেকে আমার নাটকটা দেখতে এসেছিলেন! ডাক্তার বাবু বলেছিলেন ‘এমনিতে নাটক-টাটক দেখার সময় পাই না, কিন্তু তোমার নাটকটার- কি যেন নাম- ‘এখন অসুখ’ তাইতো’? আমি ঘাড় নাড়লাম, ডাক্তার বাবু বলেছিলেন ‘হ্যা, ওই নামটা আমাকে আকর্ষণ করলো, আসলে আমি তো ডাক্তার, তাই ভাবলাম দেখি নাট্যকার কোন অসুখের কি ডায়াগনোসিস করেছে’।
অবাক হলাম, আবার ভালোও লাগলো। নাটকটা ছিল এক প্রবীণ দম্পতির আত্মযন্ত্রণার ছবি। তাদের একমাত্র সন্তান বিদেশে চাকুরী করতে গিয়ে সেখানেই থেকে গেছে। বিয়ে করার পর গত পনেরো বছরে একদিনের জন্যও বাবা মাকে দেখতে আসেনি। টাকা পাঠায়, ফোন করে, খবর নেয় কিন্তু একদিনের জন্যেও তার সময় কিংবা ইচ্ছা হয়না। এদিকে মা’র মৃত্যু হয়, খবর যায়। ছেলে আসবে বলে বৃদ্ধ বাবা একদিন মৃতদেহ রেখে দেন, ছেলে তার গর্ভধারিনীকে দেখতে আসবে। কোন ফ্লাইটে আসবে ছেলে তাও জানিয়েছে। বাবা পথ চেয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ মুহুর্তে ছেলের বদলে আসে একটা ফোন- ‘বাবা, কাজের চাপে যেতে পারছি না, টিকিট ক্যান্সেল করেছি’।
তবে কি ডাক্তার বাবু আমার নাটকে নিজেকে খুঁজতে চেয়েছিলেন? ভাবলাম। কিন্তু ডাক্তার বাবুর ছেলে তো বিদেশে পড়ে না। সেদিন ডাক্তার বাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম, পরে আরো অনেকবার। ডাক্তার বাবুও আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলেন। একদিন ডাক্তার বাবুকে বললাম- ‘ডাক্তার বাবু, আপনি তো মনের নানান জটিল রোগের চিকিৎসা করেন, আপনার কেস স্টাডি থাকে একটা গল্প বলুন না, যা থেকে একটা নতুন নাটক লিখতে পারি’। ডাক্তার বাবু মিনিট খানেক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা পুরোনো খবরের কাগজ আমাকে দিয়ে বললেন, পড়ো। দেখলাম কাগজের তারিখটা ১৬ই এপ্রিল ২০০২। একটা সংবাদে দাগ দেওয়া রয়েছে, পড়লাম। ক্লাস সেভেনের একটা ছেলে তার সহপাঠীকে চেয়ারে বেঁধে গলা টিপে খুন করেছে। যাকে মেরেছে সে ওর স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিল, খুনি ছেলেটিও খুব মেধাবি ছাত্র ছিল, তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এইটুকুই মাত্র ছিল খবরটা। ঘটনাটা আমি জানতাম, কাগজে দেখেছিলাম, তখন সবেমাত্র মাধ্যামিক পাশ করেছি, তারপর ভুলেও গেছি। এমন ঘটনা এতো ঘটেছে যে তা জেনে কেউই আর বিচলিত হয়না, আমিও হইনি। আমি বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার বাবু, এইটুকু মাত্র কাহিনি নিয়ে নাটক হবে কি করে? নাটকীয়তা কোথায়’? ডাক্তার নন্দী মনে হলো সামান্য উত্তেজিত হলেন ‘কি বলছো তুমি নাট্যকার, নাটকীয়তা নেই? একটা এগারো বছরের নিষ্পাপ শিশু তার সহপাঠীকে খুন করলো, নাটকীয়তা নেই বলছ’? আমি বললাম ‘না, মানে পরের ঘটনা গুলো না জানলে...’, কথাটা শেষ হল হল’না, ডাক্তার বাবু বললেন ‘বলবো, সব বলবো, তবে আজ নয়’, এই একটি মাত্র কেসই আমি স্টাডি করছি বারো বছর ধরে’।
সেদিন চলে এলাম, অনেকগুলো ছবি মনে ভীড় করলো। কি হ’ল ছেলেটির, সে কি পেশাদার অপরাধী হ’য়ে গেল? তার মা, তাঁরই বা কি পরিনতি হলো? আবার নিজেকে তিরস্কার করলাম, দূর! আমি কি জম্পেট টেলি সিরিয়াল লিখছি নাকি! আমার মস্তিষ্ক জুড়ে ঐ কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সমাজের এ কোন গভীর অসুখ! কার পাপে একটা নিষ্পাপ শিশু খুনি হয়ে যায়! ক’দিন পরে ডাক্তার বাবুর ডাক পেয়ে গেলাম। ‘তোমাকে খুব দরকার, আমার একটা উপকার করতে হবে, আমার কাজে লাগবে তোমার সাহায্য’। আমি বুঝতে পারলাম না আমার মত একটা থিয়েটার করা তরুণ অত বড় মাপের চিকিৎসকের কি কাজে লাগবো। বললেন ‘তোমাকে একটু অভিনয় করতে হবে, দশ পনের মিনিট। আমার চিকিৎসার এটাই শেষ ধাপ হতে পারে, আমি নিশ্চিত এই শেষ ধাপটা পেরোলে রোগী হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে, ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাবে’। আমি বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার বাবু, আমার নাটকের কাহিনিটার কী হবে, আজকে বলবেন না’? বললেন ‘হ্যা হ্যা আজই বলব, মাত্র আট-দশ মিনিট, আমাকে আমার চিকিৎসার শেষ ধাপটা পেরোতে দাও’।
আমি সম্মোহিতের মত শুনে যাচ্ছিলাম, ডাক্তার বাবু আমাকে দিয়ে কি করতে চাইছেন? ডাক্তার বাবুর কথায় হুঁশ ফিরল, ব’ললেন, ‘শোন, আমি একজনকে নিয়ে আসছি, তোমার কাকিমার যা বয়স হওয়া উচিত সেই বয়সী, তুমি তার ছেলের বন্ধু, আজই দেরাদুন থেকে এসেছ’। একটা সাদা খাম আমার পকেটে দিয়ে বললেন ‘চিঠিটা ওর হাতে দেবে, কোন প্রশ্ন করলে ইতিবাচক উত্তর দেবে, হ্যা, বলা হয়নি ও কিন্তু চোখে দেখতে পাই না, ঠিক আছে? আমি আসছি’। এক সুদর্শনা মহিলাকে নিয়ে ভেতরে এলেন, সত্যিই কাকিমা বলে ডাকতে ইচ্ছা হ’চ্ছিল- অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী চেহেরা। ডাক্তার বাবু বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন ‘দেখ সুপর্ণা, শুভর বন্ধু এসেছে, পাঠিয়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে’। আমি নিপুন অভিনেতার মত প্রণাম করলাম, উনি বললেন, ‘তুমি শুভর বন্ধু? শুভ কেমন আছে? পরীক্ষাতে ফার্স্ট হয়েছে তো?’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ কাকিমা প্রত্যেক বছর ওই তো ফার্স্ট হয়, এবারও হয়েছে, ও ছাড়া আর কে ফার্স্ট হবে’? উনি বললেন ‘ঠিক বলেছ, জান কত বকতাম- বলতাম তোমাকে সমস্ত পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে, ও কথা রেখেছে। কিন্তু কবে আসবে শুভ কিছু বলেনি’? স্টেজে মেক আপ করার মত আমি বললাম ‘এই তো সামনের পূজোর ছুটিতেই আসবে বলছিল, আমাকে একটা চিঠিও দিয়েছে’ বলে পকেট থেকে একটা সাদা খাম উনার হাতে দিলাম। বললেন ‘শুভ চিঠি দিয়েছে? ওতে লেখা আছে পূজোর ছুটিতে আসবে?’ বললাম ‘হ্যাঁ সেরকমই তো বললো’। উনি চিঠিটা বুকে চেপে ধরলেন। আমি মঞ্চে অভিনয় করি, কিন্তু ছেলের জন্য দৃষ্টিহীন মা’র ভালোবাসার এমন প্রকাশ আমাকেও দুর্বল করে দিল বইকি! আমাকে আর বেশিক্ষণ অভিনয় করতে হ’লনা, ডাক্তার নন্দী বললেন ‘এবার তুমি ভেতরে যাও সুপর্ণা। শুভর বন্ধু এখনো নিজের বাড়িতেই যায়নি, অনেক দূর যেতে হবে’। উনি বললেন ‘যাও বাবা, শোন, তুমি ফিরে যাবার আগে, একবার দেখা করে যেও, শুভর জন্য আলুর চিপস কিনে রাখবো, নিয়ে যেও, ও আলুর চিপস খেতে খুব ভালোবাসে’। ডাক্তার বাবু উনাকে ভেতরে রেখে এলেন।
আমি বুঝলাম আজকে আর গল্পের শেষ শোনা হবে না। বললাম, ডাক্তার বাবু আজ তবে আমি যাই। উনি বললেন, ‘আরে, বোস বোস গল্পের বাকিটা শুনবে না’? আমি ব’সলাম। ডাক্তার বাবু ব’লে চললেন। ‘ছেলেটা পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল, কিন্তু শুধু ভালো হ’লেই তো হবে না, ওর মা চাইতো ওকে ফার্স্ট হ’তে হবে প্রতিটি পরীক্ষায়, সব কিছুতেই। খেলা ধুলো ছবি আঁকা সব বন্ধ- শুধু দৌড় ফার্স্ট হওয়ার জন্য। সেবার ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষায় ছেলেটি সেকেন্ড হয়েছিল। ওর মা খুব বকাবকি করেছিল, গল্পের বই, ছবি আঁকা সরঞ্জাম- সব ফেলে দিল, শুধু স্কুলের বই পড়তেই হবে আর ফার্স্ট হ’তে হবে। ছেলেটির মা’র এই বিকৃত মানসিকতার দাবি মেটানোর চাপ ওইটুকু ছেলে সামলাবে কি করে ? তাই তার সহপাঠী যে বারবার ফার্স্ট হ’ত তাকেই সরিয়ে দিল গলা টিপে খুন করে’। আমি শুধু বললাম ‘তারপর’? ডাক্তার নন্দী ব’লে চললেন ‘জুভেনাইল কোর্টের বিচারে সাজা হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর- সব কথা অকপটে স্বীকার করেছিল বলে। খুব মেধাবী ছিল, সংশোধনাগারে পড়াশোনা ক’রে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে, তারপর জয়েন্ট এনট্রান্সে সফল হয়ে এখন ডাক্তারি পড়ছে। এই বারোটি বছর ছেলেটি তার মাকে দেখেনি। পূজোর ছুটিতেই যদি আসে...’। আর বললেন না। দেখলাম, আপাত কঠিন মনের ডাক্তারের চোখ দুটো জলে চিক চিক করছে।
জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি সেই ছেলেটারও মানসিক চিকিৎসা করেছিলেন? বললেন, ‘না, তার তো চিকিৎসার দরকার ছিল’না, চিকিৎসার দরকার ছিল তার মা’র, বারো বছর ধরে আমি তারই চিকিৎসা করে চলেছি, ক্রমেই সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে’।
‘আর সেই ছেলেটি’? আমি কৌতুহল চাপতে পারলাম না। ডাক্তার নন্দী আমার মুখের দিকে তাকালেন, বললেন ‘সেই ছেলেটিই শুভ- শুভঙ্কর, একটু আগে তুমি যার বন্ধুর অভিনয় করলে। শুভঙ্কর আমারই ছেলে’। এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা আমাকে আচ্ছন্ন ক’রলো। শুধু ডাক্তার বাবুর কথা শুনে চলেছি- ‘আর যাকে তুনি শুভঙ্করের বন্ধু হয়ে প্রণাম ক’রলে সে শুভঙ্করেরই মা, ১২ বছর ধরে আমি যার মনের জট খোলার চেষ্টা ক’রে চলেছি’। আমি কয়েক মিনিট কোন কথা ব’লতে পারলাম না। ডাক্তার বাবুর কথায় ঘোর কাটলো। ‘এবার তবে এসো, অনেকক্ষণ তোমাকে আটকে রাখলাম’। আমি উঠলাম, শুধু অস্ফূট স্বরে বললাম, ‘কাকিমা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে উঠবেন তো’?
ডাক্তার বাবু ব’ললেন ‘হ্যাঁ, আশাতো করছি, শুভ এসে সম্পূর্ণ সুস্থ মাকে দেখতে পাবে, তবে...’ ভারি হয়ে আসা কন্ঠে বললেন, ‘দুঃখ একটা থাকবে যে ছেলেকে সে সে দেখতে পাবে না, স্পর্শ ক’রতে পারবে মাত্র। মাঝে মাঝে এসো, শুভর বন্ধু হয়েই এস, তোমাকে স্পর্শ ক’রে হয়তো তোমার কাকিমা আর একটু তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবে। আর হ্যাঁ, নাটকটা লেখা হলে আমাকে পড়াবে’। ‘আসবো, নিশ্চয় আসবো’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় বেরিয়ে নিজেকে ব’ললাম- লিখবো, নাটকটা লিখবো। কিন্তু কাকে নিয়ে? সমাজের গভীরতর অসুখের বিরুদ্ধে ডাক্তার নন্দীর নিঃশব্দ সংগ্রাম, না কি সেই গভীর অসুখের মুখে লাথি মেরে নিজের সহপাঠীকে খুন করা সেই ছেলেটির ডাক্তার শুভঙ্কর নন্দী হয়ে ওঠার কথা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন