পৃষ্ঠাসমূহ

স্বস্তি

 II মৌ দাশগুপ্ত II
 

সদানন্দবাবুর ছেলে ঋজুর প্রেম করে বিয়ে। তার পর থেকেই বিপত্নীক সদানন্দবাবু ছেলেরসংসারে বিগত কয়েক বছর যাবত যেন অপাংক্তেয় হয়ে পড়ছেন ,নেহাত বাড়িটা এখনো ওনার নামে বলে থাকতে পান আরকি। মৈত্রেয়ী তার ক্লাব, বাপের বাড়ী, বন্ধু-বান্ধবী ,সোস্যাল ওয়ার্ক, ফেসবুক, হোয়াস এপ,শখের বিউটিপার্লার এসব নিয়েই ভারি ব্যস্ত। ঋজুর ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। একটা বাচ্চা কাচ্চা থাকলেও হত। তাও তো নেই। ছেলে বউয়ের ঝগড়া কথা কাটাকাটি থেকে যতটা বুঝেছেন দোষটা বোধহয় ঋজুরই। মৈত্রেয়ী তো সরাসরি বলে কথাটা, ঋজুর পক্ষে নাকি বাবা হওয়াই সম্ভব না। আর এই সব নিয়েই বিয়ের পর সাতটা বছর পার হতে না হতেই দুজনের নিত্যৈমত্তিক ঝামেলা, ঝগড়াঝাটি, কথাকাটাকাটি, সেখান থেকে থুতুছেটানো, মা-বাবার নামে গালিগালাজ, টেবিলের ফুলদানি থেকে ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলা, তারপরেই গায়ে হাত তোলা, আর কেঁদেকেটে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। এসব দেখে শুনে প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতেন। ঘরে আর কোনদিন বাচ্চার কান্না হাসি শোনা যাবেনা? টলোমসো পায়ে ওনার হাত ধরে কেউ হাঁটবে না এবাড়িতে? কাউকে দাদুভাই বলে ডাকতে পারবেন না কোনদিন? তবে কি ঋজুর পর এ বংশে বাতি দেবার কেউ থাকবে না? পুন্নাম নরকের ভাগীদার হবেন ওনার পূর্বপুরুষরা? ওদিকে ওনার শান্ত প্রকৃতির কম কথা বলা ছেলেটাও ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে। আজকাল তো আবার নেশাভাং করাও শুরু করে দিয়েছে। ড্রাইভারের কাঁধে ভর দিয়ে যেভাবে বেহেড অবস্থায় ঘরে ঢোকে তাতে মাথা কাটা যায় সদানন্দবাবুর। যতই হোক রিটয়ার্ড হেডমাস্টার বলে কথা। সকালে কখন যে ওঠে আর কখন বেরিয়ে যায় কে জানে। বাপের মুখোমুখিও হয়না। কতদিন ছেলেটার সাথে ভালোকরে কথাই বলা হয়নি। প্রথম-প্রথম কষ্ট পেতেন। অভিমানে অপমানে চোখে জল চলে আসতো। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। মৈত্রেয়ীর ওপরও কোন ক্ষোভ নেই সদানন্দবাবুর। একটা মেয়ের কাছে মা হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ বোধহয় আর কিছু নেই। ঋজুর মাকে দেখেছেন তো এতগুলো বছর। খুব বোঝেন যে মা না হতে পারার ক্ষোভ থেকেই এত বিরক্তি, এত রাগ,এত ঘেণ্ণা মৈত্রেয়ীর। কিন্তু ঋজু? সংসারে শান্তি না থাকলে মানুষ কি এভাবেই নিজেকে নিজে শেষ করে দেয় নাকি? কে জানে! তবে ওরাও ওদের সমস্যায় সদানন্দবাবুকে ডাকেনা আর উনিও সেধে ওদের সমস্যায় নাক গলান না।আসলে সদানন্দবাবু বোঝেন যে এখন নিজের সংসারে উনি একেবারেই অপাংক্তেয়। তাই হয় নিজের ঘরে বসে বই পড়েন, নয়, মাঝেমধ্যেই ঘুরে আসেন সমবয়সী ওনার মত দু একজনকে সঙ্গী করে এদিক-ওদিক।ঘরে কেউ কিছু জানতেও চায়না, উনিও জানান না। শুধু ঘরটায় তালা দিয়ে একটা কাগজ ঝুলিয়ে দেন। বাইরে যাচ্ছিঘরের ভিতর নিজেই স্বপাক খান। নিজের পেনসনে নিজের মত থাকেন। 

সেবার পূজোর পর থেকে টানা আড়াইমাস ওনার প্রাক্তন সহকর্মী মধুমাষ্টার ওরফে মধুমঙ্গল গাঙ্গুলীর গুরুদেবের হরিদ্বারের বৈদিক আশ্রমে কাটিয়ে বেশ তরাজা মন নিয়ে ঘরে ফিরেই টের পেলেন কোথাও যেন তাল কেটে গেছে। সদর দরজা হাট করে খোলা। জুতোর তাকের সামনে তিনচার জোড়া খোলা জুতো।এই ভরদুপুরে ঘরে কেউ থাকেনা। কিন্তু আজ তো রীতিমত শোরগোল চলছে। নিজের ঘরেরতালা খুলতে গিয়েও থমকে গেলেন সদানন্দবাবু। মৈত্রেয়ীর ঘর থেকে বেশ উত্তেজিতভাবে কথা ভেসে আসছে। একইসাথে দুতিনজন কথা বলছে। গলা শুনে মনে হল ওর দুই দাদা নীল আর সবুজ। নীলটা একটু গোঁয়ার গোবিন্দ, সবুজটা চালাক-চতুর।
-   পারা যায় না তোকে নিয়ে। খুব তো লাভ ম্যারেজ করলি। তখনই বারণ করেছিলাম। কারো কথা শুনলিনা বাড়ীতে। আর এখন? এখন সেই তো নাকে কান্না শুরু করলি? প্রথমেই বাড়ীর বড়দের কথা শুনলে আজকের দিনটা দেখতে হোত না। যত্তসব উটকো ঝামেলা!
-   তুই থাম দাদা। যা হবার হয়ে গেছে।সেটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। বোন তো আমাদের। ফেলতে তো পারবনা। ভাগ্নেটাও আছে।আর তোকেও বলি বোনু, জানিসই তো  আমাদের প্রোমোটারির ব্যাবসা। বাজার টাইট। গুচ্ছের লাফড়া। রোজরোজ এখানে এসে সময় নষ্ট করা অসম্ভব।
-   মেলা কপচাস না সবুজ।আমাদের ফুরসত কোথায়? তাচ্চেয়ে বরং রফিকভাইকে পাঠিয়ে দে, ও শালীকে চমকে দিয়ে আসবে। চাই কি সাথে জামাইকেও মোলায়েম হাতে দুরমুশ করে কদিনের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়েও দেবে। হারামজাদার সব রস ফুসসস হয়ে যাবে।
-   দেখ বোনু ঋজু যা করছে, অন্যায় করছে। চরম অন্যায়।ওইধরনের একটু এদিকওদিক বাই অনেক ছেলেরই থাকে। তার ওপর চিরজীবন মেসোমশাইয়ের হেডমাস্টারি শাসনে থেকেছে। মাপা পয়সা, মাপা আমোদ আনন্দ। এখন নিজে দুহাতে রোজগার করে। মেসোমশাইয়ের ভয়ও নেই। তোর তো বর। তুইই বা কি করে এতদিন চোখ বুজে ছিলি? আপনা ভালো তো পাগলেও বোঝে। তুই কি তারো অধম।ঋজু একটা মেয়ের সাথে এমন লটঘটে জড়িয়ে পড়ল যে একটা বাচ্চা অবদি পয়দা হয়ে গেল আর তুই বলছিস তুই কিছুই জানতি না। এটা সম্ভব? এতটা বাড়াবাড়ি হবার আগেই তোর উচিত ছিল ঋজুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঐ নোংরামো থেকে টেনে আনা।
-   একদম ঠিককথা, তোকেও বলিহারি যাই বোনু।তুই আজকালকার মেয়ে, কেন যে করিস নি, তুইই জানিস। এখন তুই ইচ্ছা করলে বাড়ি গিয়ে উঠতেই পারিস বা যদি চাস কোর্টেও যেতে পারিস, তবে তুই ই তো বলছিস সেটা কোন সলিউশন নয়। তালে তো তোকেই বুদ্ধি খাটিয়ে সামাল দিতে হবে। তুইই ভাব কি করবি।
-   এখন তোর শ্বশুরই তো ভরসা। তা সে বুড়োও তো সময় বুঝে ঠিক এখনই কেটে পড়েছে। ব্যাটা মেসোমশাই আসুক। তারপর দেখাচ্ছি মজা। ওর একদিন কি আমারই একদিন।
কথাগুলো শুনতে শুনতেই নিজের ঘরের দরজা খোলেন সদানন্দবাবু। ঘরে ঢুকে ক্যম্বিসের ঝোলা ব্যাগটা টেবিলে রেখে জুতো খুলে বাথরুমে ঢোকেন। দুই আর দুই মিলে চার হওয়ার মত সমস্যার আদ্যপান্ত ওদের তিন ভাইবোনের কথা থেকে বুঝে গেলেন সদানন্দবাবু। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল ওনার। ওনার ছেলে হয়ে এতটা নীচে নামতে পারলো ঋজু। ছি ছি। কি মুখ নিয়ে বৌমার সামনে দাঁড়াবেন এখন। ভাবতে ভাবতেই চোরাস্রোতের মত একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তির তিরতিরে ধারা ওনার বুকের মধ্যে টের পেলেন সদানন্দবাবু। ঋজু তবে বাবা হয়েছে? ওনার বংশ তাহলে টিঁকে যাবে? একটা গভীর স্বস্তির শ্বাস ফেলে মাথায় জল ঢালতে শুরু করলেন।

---------




লেখক পরিচিতি


বর্তমান বাসস্থান : মাধবনগর , কাতনি, মধ্যপ্রদেশ ।

পেশা: সিনিয়র কনসালটেন্ট ইনভারোটেক ইস্ট প্রাঃ লিঃ । 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন