নরেশ মণ্ডল
মেইন গেটের সামনে সে অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়েছিল। এখানে দাঁড়াবার বড় কারণ হলো কেউ এলে বা গেলে দেখা হবার সম্ভাবনা
প্রবল। ঘড়িটা দেখে। না এখনও সময় পার হয়ে যায়নি। ঠিক দুটো দশ নাগাদ দেখতে পেল।
ওড়নাটা ঠিক করতে করতে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু দেরির জন্য তার কোনো ভূমিকার দরকার
পড়ে না। নির্বিকারভাবে পাশটিতে এসে দাঁড়ায়। বলে –
-তুমি কখন এসেছো। নিশ্চয় অনেকক্ষণ।
-কে বলল।
-না, কেউ বলেনি। তোমার মুখ দেখে মনে হলো।
-তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট
হলে ভালো হতো।
-তুমি ঠিক বলেছো। তোমার
মতো অনেকেই আমাকে এই কথা বলেছে।
-মানে ! আমার মতো অনেকে !
-তাহলে আমি...তাহলে...।
আর কথা এগোয় না ওর মুখে। কে যেন মাঝপথ আটকে দিয়েছে। যেখান থেকে বেরতে পারছে না সে।
মনের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভব করে। অব্যক্ত সে বেদনা। আশপাশের গাছের সবুজ পাতাগুলো
তির তির করে কেঁপে ওঠে। ওরাও কি অনুভব করতে পারে ! আকাশে কথাগুলো বিষণ্ন মালার মতো ছড়িয়ে যায়। যে কোন মুহূর্তে তা বৃষ্টি হয়ে
ঝরে পড়বে। কারা যেন কথা বলে।
-কি হলো তোমার। কেমন
যেন হয়ে গেলে।
-কই। না না, তুমি ভুল দেখছো।
-আমি ভুল দেখছি।
-ঠিক।
-ঠিক মানে। আমি চোখে
ভালো দেখতে পাই না। সেটা বোঝাতে চাইলে। তাই না। নিজেকে খুব চক্ষুষ্মান মনে কর।
-আরে বাবা আমি সে কথা
তোমায় কখন বললাম। তুমি না বেশ বানিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে কথার
জাল বুনতে পারো। তোমার কথায় কত না জানি প্রজাপতি জড়িয়ে পড়েছে সেটা জানাটা তো খুব
জরুরি দেখছি। তুমি তো দেখছি বিশ্বাসের সীমারেখা পার হয়ে যাচ্ছ। বেশ দক্ষ তো তুমি এ
ব্যাপারে। আগে তো ঠিক বুঝতে পারিনি। তলে তলে কতটা জল খাচ্ছো। কী হলো এবার চুপ কেন।
-আমি তো তোমার কথার কোনো মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। আমি মাকড়শা। জাল বুনি ! তাতে প্রজাপতি ধরি। ডুবে ডুবে জল খাচ্ছি ! মানেটা কি মিস্টার ? তুমিতো দেখছি বেশ দক্ষতার সঙ্গে চক্রব্যূহ রচনা করছো।
-আমি তো তোমার কথার কোনো মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। আমি মাকড়শা। জাল বুনি ! তাতে প্রজাপতি ধরি। ডুবে ডুবে জল খাচ্ছি ! মানেটা কি মিস্টার ? তুমিতো দেখছি বেশ দক্ষতার সঙ্গে চক্রব্যূহ রচনা করছো।
-কি আমি চক্রব্যূহ রচনা
করছি। আমার নামে দোষারোপ করা। এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না। আমি তাহলে...
-বা, কী সুন্দর। নিজে সাজিয়ে এখন আমার নামে বদনাম দিচ্ছো। আমি আর
একমুহূর্তও এখানে থাকব না। তোমার মতো মানুষের সঙ্গে মেশাটাই আমার ভুল হয়েছে।
সুস্মিতা তখন ঠিকই বলেছিল। দেখেশুনে মিশিস। যার তার সঙ্গে মিশবি না। বিপদে পড়বি।
এখন তো দেখছি ও ঠিক কথাই বলেছিল। আমি ওর কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে দেখছি ভুল
করেছি। সত্যি তো ! বলে একবার ওর মুখের
দিকে তাকায়। দেখে মেঘলা।
-আবার চলে যাবার হুমকি
দিচ্ছো। তুমি
তো ভালো অভিনেত্রী।
-আমি অভিনেত্রী !
তুমি আমাকে এ কথাটা বলতে পারলে। চললাম। আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
মাথা ঠাণ্ডা করো। চা খাও গিয়ে। বলে হন হন করে পা চালায়।
-অপেক্ষা করছে মানে ?
-মানে কেউ অপেক্ষা
করছে। তোমার মতো। হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিয়ে যায়।
রাত বাড়ে। অমিতেশ বারান্দায় চেয়ারটা টেনে
নিয়ে বসে। সেই যে ফিরে এসেছে তারপর আর বাড়ির বাইরে বের হয়নি। দরকার ছিল কিন্তু ওর
বেরুতে ইচ্ছে করেনি। ফিরে এসে শুয়ে ছিল। বেশিক্ষণ পারেনি। উঠে পড়ে। একটা বই নিয়ে
বসে। অনেকদিন পড়ে আছে পড়া হয়নি। মাঝের অসুস্থতা ওর অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে।
এই বইটার একটা আলোচনা না করে দিলে নয়। বেশ তাগদা দিচ্ছে। কয়েকটা পাতা পড়ে। আর মন
বসাতে পারে না। দুপুরের ঘটনাটা তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না।
-মা, মাসিকে বলতো একটু চা দিতে
-এখন চা খাবি !
-হ্যাঁ, ভালো লাগছে না।
মা বিছানা থেকে উঠে আসে। কি
হয়েছেরে বাবু। বাড়ি ফেরার পর থেকে কেমন যেন গুম মেরে আছিস। মাঝে মাঝে বারান্দায়
যাচ্ছিস। কতবার চা খেলি বল তো। শরীর খারাপ তো নয়। ও কি তোকে কিছু বলেছে।
-তুমি গিয়ে শুয়ে পড় মা।
রাত হয়েছে। তোমার শরীর খারাপ হলে খুব সমস্যায় পড়ে যাব। এমনি আমার অসুখের জন্য অনেক
দিন ছুটিতে কেটেছে। তোমার কিছু হলে বুঝতেই পারছো। যাও শুয়ে পড়।
পরিবারের রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে গিয়েছে
অমিতেশের অসুখের সময়। রাত তখন বেশ গভীর। বেডে সে ছটফট করছে যন্ত্রণায়। নার্স দেখে
যাবার পর ডাক্তারবাবু এসেই ওটির ব্যবস্থা করতে বলেন। খবর যায় সিনিয়র ডাঃ বোসের
কোয়ার্টারে। রক্তের প্রয়োজন হয়। বাড়িতে খবর দিতে বারণ করেছে অমিতেশ। কাগজপত্রে
আগেই সই-সাবুদ করে রেখেছে সে। যাতে রাতবিরেতে কিছু হলে মাকে যেন ব্যস্ত হতে না হয়।
রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়। অপারেশনও। কোনো নতুন উপসর্গ দেখা দেয়নি। রোগী ভালোই
আছে।
অমিতেশের
খবরটা সকালে শোনার পর উদ্বিগ্ন অমিতাদেবী ভাইপো মিহিরকে পাঠান। সব শুনে তিনি
নিশ্চিন্ত হন বটে। রক্ত দানের ব্যাপারটা জানার পর নিজেকে অনেক বোঝ দেবার চেষ্টা
করেন। মিহিরও বোঝায়। রক্তের কোনো জাত হয় না। ধর্ম দিয়ে মানুষ বিচার করাটা ঠিক না। দিনকাল অনেক
পালটে গেছে। একজনের জীবন বাঁচাতে অন্যজন এগিয়ে আসে। না হলে মানুষ বাঁচবে কি করে।
একে অপরের পাশে থাকবে এটাই তো ঠিক।
বিকালবেলা খাটের উপর আধশোয়া অমিতেশ। কেমন আছেন ?
ফুল হাতে শামিমা।
-ভালো। কিন্তু আপনাকে
তো ঠিক চিনতে পারলাম না। নামটা...
-শামিমা।
বুকের ভেতর ঢাকের বোল। চেয়ে
থাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। চোখ নামাতে পারে না অমিতেশ। শামিমা !
তুমি ! শামিমা। তুমি বললাম বলে কিছু মনে করলে
না তো। কথাটা বেরিয়ে গেছে।
-কেন কি হয়েছে। তুমি
বলতে পারেন। কোনো অসুবিধে নেই।
-তোমাকে দেখব বলে দু'দিন অপেক্ষা করেছি।
-আমার জন্য ! আমি একজন সাধারণ মানুষ। অপেক্ষা করার কি আছে। কেউকেটা হলে না হয় কথা ছিল।
তাই না। আপনি কি বলেন।
কথাগুলো রিনিঝিনি শব্দ করে
কানের ভেতর ঢুকল। ছড়িয়ে পড়ল মনের এদিক সেদিক।
শামিমা,
তুমি ডাক্তার না হয়ে উকিল হতে পারতে।
-তাই। তাহলে যে আপনি
আমায় দেখতে পেতেন না। এত কথাও বলতে পারতেন না।
-না, না তুমি ডাক্তারই ভালো। অন্য কিছু হতে হবে না। ডাক্তার না হলে আমাকে দেখতো
কে। তুমি এখানে বোসো। তুমি রোজ আসবে তো। আবেগ মিশ্রিত গলায় বলে অমিতেশ।
-আমি কেন রোজ রোজ আসতে
যাব ! এই তো দেখে গেলাম আজ। আপনার ছুটি হবার আগে পারলে একদিন
দেখে যাব। যদি সময় পাই। কিছু মনে করবেন না। অনেক রোগী তো আমাদের দেখতে হয়। তাই না
অমিতেশ বাবু। সবার কাছেতো রোজ রোজ এত সময় বসে কাটানো যায় না। আপনি আজ আছেন কাল
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। ভলো থাকবেন। আপনার মতো আরও কত রোগী আসবে। চলেও যাবে।
এই বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হয়।
অমিতেশ কোনো কথা বলতে পারে না। শুধু শামিমার
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শান্ত অথচ কি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। সাজগোজে নেই কোনো উগ্রতা।
লাবণ্য আছে। মায়াময় চোখ।
-ঠিক কথা বলেছো তুমি।
তবু যাবার আগে যদি একবার আসো।
রাত বাড়তে থাকে।
চায়ের কাপটায় চুমুক দেয় অমিতেশ। মনের মধ্যে তোলপাড় করে। শামিমা কেন এমন ব্যবহার
করল। ও কি অন্যায় করেছে। কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুই মনে করতে পারছে না। শরীরটা
কেমন করছে। জ্বর জ্বর ভাব। চা-টা শেষ করে সে টলমল পায়ে নিজের
ঘরে চলে যায়। চটিটা কোনো রকমে খুলে বিছানায় গা-টা এলিয়ে দেয়।
বেলা বাড়ে। অমিতেশকে চায়ের টেবিলে না দেখে
অমিতা ছেলের ঘরে আসেন। চাদর গায়ে দেখে কাছে গিয়ে ছেলেকে ডাকেন। কোনো সাড়া না পেয়ে
গায়ে হাত দেন। জ্বর ! কপালে হাত ছোঁয়ান। গা
যে পুড়ে যাচ্ছে।
কপালে জল-কাপড় দিতে হবে। মাসি জল-কাপড় দিয়ে যায়। অমিতা ছেলের
মাথার কাছে বসে ভেজা কাপড় বার বার পালটে দিতে থাকেন। গা-টাও
মুছিয়ে দেন ভালো করে। মাথাও ধুয়ে দিয়েছেন। আর একবার জ্বরটা দেখেন। আগের থেকে
কমেছে। একটু আস্বস্ত লাগে। কখন থেকে জ্বরটা হলো জানতে পারেননি। মায়ের মন। অস্থির
লাগে। অমিতেশ একটু ঘাড় কাত করে। মাথা তোলার চেষ্টা করে। পারে না।
-এখন কেমন লাগছে। চা
খাবি?
-দাও। অস্পষ্ট স্বরে
বলে অমিতেশ।
অমিতা নিজের হাতে
চা নিয়ে আসেন। সঙ্গে যে আসে তাকে দেখে অমিতেশ অবাক হয়ে যায়। তুমি ! দুকাপ চা নামিয়ে রাখেন অমিতা। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর
শামিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, বসো। থুতনিতে হাত বুলিয়ে
চুমু খান। ঘর থেকে চলে যেতে যেতে বলেন, আমি খাবারের ব্যবস্থা
করছি।
-তুমি আমাকে দেখে খুশি
হওনি তো। বিরক্ত বোধ করছো। কি, তাই তো।
-তুমি এসব কি বলছো।
অস্পষ্ট স্বরে কথাগুলো বলে। শরীরটা ভালো না।
-কি হয়েছে তোমার। দেখি।
এখনও তো জ্বর আছে। বেশ হয়েছে কদিন বাড়িতে থাকো বসে। বাইরে বেরুতে পারবে না। আমি
ঘুরে বেরাবো। একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। কেউ আছে বাড়িতে যাকে দিয়ে আনিয়ে নিতে পারবে !
না আমি এনে দেব। না ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। বলে চা শেষ করে শামিমা বের
হয়। রান্নাঘরের কাছে গিয়ে বলে, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ওষুধ
আনতে।
-তুমি বসো না। সুমিতাকে
পাঠাবো।
- না না বেশি সময় লাগবে
না। আমি নিয়ে আসছি।
মাথার কাছে টেবিলটায় ওষুধগুলো রাখে। কোনটা কখন খেতে হবে লিখেও দেয়। মনে
করে খাবে কিন্তু। কদিন বিশ্রাম নাও।
যাবার আগে অমিতেশের কপালে
হাত রাখে। না, ঠিক আছে। আস্তে আস্তে
কমে যাবে। এবার আমি যাই। অমিতেশ ওর হাতটা চেপে ধরে। বলে, আমার
মতো কেউ অপেক্ষা করছে।
করতেই পারে, বলে শামিমা ঘর থেকে বেরিয়ে
যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন