অসমাপ্ত ধারাবাহিক

    মজিবুর রহমান


     
     বাইরে ভাঙা আয়নাটা বাম হাতে ধরে ডান হাতের আঙুলগুলো চুলে সেধিয়ে দিই। চোখ দু’টো ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ করে মুখটা দেখে নিই। একটু চিকন হলে কেমন লাগত ভেবে নাকটা টিপে টান দিই। বাম গালের বাদামি ছোট গোল দাগটা মুখের সঙ্গে মানানসই কি না দেখি। অবশ্য এমন প্রতিদিনই পরখ করি। ধূলো উড়িয়ে কোত্থেকে আমার পোষা মোরগাটা ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে সূর্যমুখির মতো একটা মুরগিকে তাড়া করে ঠিক হাত কয়েক দূরে বেচারির ওপর চড়াও হলো। কিছুক্ষণ পর দুটো প্রাণীই ধূলোস্নান করে নিল।
    উঠান গড়িয়ে দৃষ্টি সামনে পড়তেই দেখি পলকা বাঁশের বেড়া ঘেঁষে পাশের বাড়ির জহর ভাইয়ের বউ। টিয়েঠোঁটের কোণে লাজবাটা চিকন চাঁদের হাসি। মোরগ মিথুনটা সেও বোধহয় দেখেছে। আমার ওপর বিছুটি পাতার দৃষ্টি বুলিয়ে দিয়ে কচ্ছপ পায়ে হেটে মায়ের কাছে গেল। কেমন যেন লজ্জা এলার্জির মতো সারা শরীরে ফুসকে উঠল আমার।

    সন্ধ্যায় জহর ভাইয়ের ঘর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো। কণ্ঠটা পরিচিত, ঘটনাটা ও পরিচিত। জহর ভাই আজ সকাল সকালই চামার মদের তিয়াশ মিটিয়েছে। সপ্তাহিক সকল কাজের মাঝে যে কাজটি অপরিহার্য, যে কাজটি না করলে জহর ভাই চামার মদের গুনাগুন সর্ম্পকে সন্দিহান সেই কাজটি হলো ছোটখাট ছুতোয় বউ পিটানো। নিয়মিত দর্শকের মাঝে লুলা হাসিমের মা, হাফলেডি মতি, ফুলবুজি ও সম্প্রতি ফকিরী বনে যাওয়ার আউয়াল মিয়া সহ ছোট ছেলেমেয়ের জটলা ধারাক্রম বজায় রেখেছে।
    স্বামী-স্ত্রীতে ওদের সম্পর্কটা পল্লীবিদ্যুতের তারের মতো। তাপ-শৈত্যের আবর্তনে কখনো টান টান আবার কখনো ঢিল হয়ে যাওয়া। জহর ভাই, কপাল সব সময় সাধ্যমতো কুঁচকে রাখে। আচরণ বল খোয়া কলমের মতো খড়খড়ে। তাঁকে ভালোবেসে কেউ বিয়ে করতে পারে আমি তা ভাবতেও পারি না। কিন্তু তাই হলো। ফুল জড়ানো কচি লাউয়ের মতো এ ভাবিই কিনা পালিয়ে বিয়ে করল তাঁকে। বিয়ে হলো দু’বছর। বিয়ের নতুন ছয় মাস ভালই কাটছিল দিনকাল। কিন্তু তার পরেই জহর ভাইয়ের হঠাৎ ছয় মাসের জন্য প্রশস্ত কপালটা কুঁচকে যেতে লাগল। অনেক মার খেয়েছে ভাবি। মায়ের কাছে শুনেছি। পিঠে নাকি বাইম মাছের মতো দাগ হয়ে গেছে কোনদিন। মেয়েটা শব্দ করে কাঁদতে জানেনা। তবে ফুঁপাতে দেখেছি। ওঁর ফুঁপানো দেখলে আমার কেন যেন শ্বাস নিতে কষ্ট নয়। তাই অনেক সময় ও যখন ফুঁপিয়ে মায়ের কাছে ঝগড়ার বর্ণনা দিতো আমি তখন বেরিয়ে যেতাম।
    জহর ভাইয়ের বউ পেটানো আমাদের পরিবারের কাছে এতটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমেছে যে চিৎকার শুনেও কেউ এখন আর ঘর থেকে বের হয় না। শুধু মায়ের মুখটা দেখি ধূপছায়ার মতো হয়ে যায়। মা কখনো জহর ভাইকে বকাবকিও করে। ফিরাতে গেলে অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে জহর ভাই। তবু আজ অলস পায়ে ওই উঠোনে গিয়ে দাঁড়াই। পাশে একটা ছেলে দু’পায়ের ফাঁকে লাঠির ওপর প্রতীকি ভর দিয়ে ‘ঘোড় সওয়ার’ খেলছে। হঠাৎ ভাবি দৌড়ে আমাদের ঘরের দিকে যেতে ছেলেটা তাঁর ধাক্কা লেগে পড়ে যায়। আচমকা পড়ে গিয়ে ছেলেটা এদিক-ওদিক তাকায় এবং ওর বাবার মুখ দেখতেই পারমাণবিক কান্না জুড়ে দেয়। কাঠের চেলি হাতে জহর ভাই এখানে এসে থামে। ছেলেটার কান্না যেন তাকে আরও রাগিয়ে দেয়। পেটানোর অতৃপ্তি নিয়ে বাজ পড়ার মতো কিছু শব্দ বের হয় ‘এক তালাক, দুই তালাক মাগি তরে দিলাম বাইন তালাক’।
    ধারাবাহিক সমাপ্তির দৃশ্যটা লুলা হাসিমের মা, হাফলেডি মতি, ফুলবুজি ও সম্প্রতি ফকিরী বনে যাওয়ার আউয়াল মিয়াকে নীরব তৃপ্তি দিয়েছে মনে হয়। গল্পটা এখানে শেষ করলে কেমন হয় ভেবে দেখলাম। কিন্তু না, শেষ করলাম না। কারণ পরদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাংলোয় বৈঠক বসে। তিন কথা নিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব থোরা কথা বলে পীর সাহেবের কাছে ব্যাখ্যার আরজ করলেন। অনেক আলাপ ও ওয়াজ নছিহতের পর সিদ্ধান্তে এলো ‘হিললা বিয়ে’। এতে জহর ভাইয়ের বিয়ে নামক যে প্রতিষ্ঠানটি তিন কথায় ভেঙে গেছে তা পুরোপুরি জোড়া লেগে যাবে। হিললা বিয়ের পাত্রের সন্ধান স্বয়ং জহর ভাই দিলেন। বাবাও রাজি। মায়ের মৌন সম্মতি। আমার ডাক পড়লে মোরগের ফুলে যাওয়া সূর্যমুখী পালকের মতো আমার ঘাড়ের নয়, পুরো শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমার ভেতরে এক অপ্রতিরোধ্য মোরগ ডেকে যায়। গতকালের দুপুরটা যেন পেয়ে বসে আমাকে। এর অনেক পর যা হলো তা গল্পের শিরোনাম।





লেখক পরিচিতি


জন্মস্থানঃ গ্রাম - আজম পুর , থানা- মোহনগঞ্জ , জেলা - নেত্রকোনা , বাংলাদেশ।

বর্তমান বাসস্থানঃ ২৭/৩ জালালাবাদ আবাসিক এলাকা , সিলেট সদর , বাংলাদেশ।

পেশাঃ ছাত্র (লোক প্রশাসন ৩য় বর্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ,সিলেট)।

পুরস্কারঃ সেরা বিতার্কিক , লোকপ্রশাসন বিতর্ক সপ্তাহ ২০১২ , শাবিপ্রবি, সিলেট।




শেয়ার করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন