সুখের লাগিয়া‬

দীননাথ মণ্ডল

    সুরোজ ডাইরিটা নিয়ে ঠাঁই বসে আছে মালঞ্চ পার্কে। বিকাল ঘনিয়ে প্রেন্ট আলোয় জ্বলে উঠেছে ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো। চারদিকে বিচিত্র রঙের পোষাকে উষ্ণ ছোঁয়ায় নির্ঝর অবাধ বন্যা।
    দু'মাস বাদেই কলেজের পরীক্ষা। ফাস্ট ইয়ারের রেজাল্ট ভালো হয়নি। সময়ের অভাবে প্রিপারেশন এবারেও তেমন নাই। সকালে টিউশনি, দুপুরে কলেজ, সন্ধ্যায় পার্ক, মেসে ফিরে এম টি এস থেকে ফ্রি কল।
    ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৭টা পেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর হোয়াটস্আপের রিংটোন বেজে ওঠে। মেসেজ আসে - "সুরোজ, বাড়িতে লোক এসেছে। কাল কলেজে দেখা হবে।"
    গত কয়েকদিন থেকে ঊষাকে একটু অন্যরকম লাগছে। গা ছাড়া ছাড়া ভাব। রাতে মোবাইল এ স্যুইজ অফ করে রাখছে।
    কলেজ ঢুকেই ঊষার সঙ্গে সুরোজের পরিচয়। তারপর ঋতুচক্রের রুটিন মাফিক বার্ষিকগতির পরিক্রমা।
    রাতে মেসে ফিরে ফোন করে ঊষাকে। স্যুইজ অফ বলছে
    পরদিন কলেজের মাঠে ঊষাকে একান্তে পায়। হাতটা আলতো করে ধরে। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। শান্ত কন্ঠে ঊষা বলে- "ওরা নজর রাখছে। আর মোবাইল উইজ করব না।"
ঊষার বাম হাতের তর্জনীতে সোনার আংটিই বাঁধানো সাদা পাথর ঝকঝক করছে। দু'দিন আগে আঙ্গুলটি অনাবৃত ছিলঢং ঢং করে তিনটে ঘন্টার আওয়াজ কানে ভেসে এল। ক্লাসে আসে দু'জনেই।
    নিরঞ্জনবাবু আর একবার ঝালিয়ে দেবার জন্য আসে পূর্বরাগের ক্লাস। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত কয়েক দিনের টানাপোড়নের আজকের ক্লাসের বৈপরীত্য। স্যারের পূর্বরাগের হিল্লোড় সুরোজের মনে ঝরা পাতার দোলা দেয়। স্মৃতির সরণিতে বেঁয়ে যায় দু'বছরের ময়ূরপুচ্ছ তরীর বেহাল দশা। কানের কাছে ঘুরপাক খায় ডাইরিই লেখা প্রতিশ্রুতি - 'হে চির সখা রহিব দু'জনে জীবনে মরণে এক সাথে এ ধরাধামে।'
    মেসে ফিরে ব্যাগটা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে আসে সুরোজটিকিট কেটে জানলার ধারে বসে। শান্ত বিকেলে রাঙা আলোয় কোলাহল ছেড়ে সবুজ মাঠের বুক চিরে বাস এগিয়ে চলে গ্রামের দিকে। রাস্তার দু'পাশের ক্ষেতের ফসল সোনালি আলোয় চকচক করছে। সারাদিন মাঠে চরে গরুগুলো বাড়ি ফিরছে।
   গ্রামের বাস স্ট্যান্ডে নেমেই দেখা হয়ে যায় সুবোধ স্যারের সঙ্গে। সুরোজকে দেখেই স্যার কাছে এগিয়ে আসে।
"স্যার ভালো আছেন?"- সুরোজ জিজ্ঞাসা করে।
"শরীর ভালো যাচ্ছে না। তুমি কেমন আছে? এই বাড়ি ফিরলে? সময় করে একবার বাড়ি এসো সুরজ।"- স্যার বলে।
"আসব স্যার," - কথা বলতে বলতে দু'জনে পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়।
    বাড়িতে গেলে মা ছেলের হাতে একটা চিঠি দেয়। স্কুলের অভ্যর্থনার নিমন্ত্রণ কপি। ভাল ছাত্রদের প্রতি বছর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ আসে।
    পরদিন আর সকলের মতো সুরোজ যায় অনুষ্ঠানে। মঞ্চের সামনে চেয়ার পাতা। এবারের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ কৃতি ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছে। সাথে তাদের অভিভাবকরাও। তারা পুরস্কার বিতরণের সময় তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে নানা স্বপ্নের কথা বলে। স্মৃতির অন্তর্জালে সুরোজ ক্রমশ ডুব দিতে থাকে। তার বাবাও একদিন এখানে সুরোজকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা জানিয়ে ছিল। স্যাররা সকলে তার প্রশংসা করে ছিল। সুবোধ স্যার বলেছিল "সুরোজ এ গায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে।" ঘেমে যায় শরীর। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পড়তে বসে। এক অজানা সংকেত বিব্রত করে মন। সে যেন সকলের কাছে হেরে যাচ্ছে।
    পরদিন মেসে ফিরে মালঞ্চ পার্কে যায় সন্ধ্যায়। মেসের অন্য রুমমেটরা ছুটিতে আছে। গত কয়েক দিন রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি।
    সকাল আট বেজে গেলে মেস মালিক সুরোজকে ডাকতে যায়। দেখে নিশ্চল হয়ে বিছানায় পরে আছে সুরোজ। বিছানায় ছড়ানো ট্যাবলেটের কতগুলি ফাঁকা মোড়ক। পাশে ডাইরির সেই পাতার নিচে লেখা - "সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল..."




লেখক পরিচিতি


জন্মস্থানঃ মির্জাপুর, মুর্শিদাবাদ জেলা, পশ্চিমবঙ্গ ।

পেশাঃ শিক্ষকতা ।

সম্পাদকঃ 'সোঁদামাটি সাহিত্য পত্রিকা' ।





শেয়ার করুন

1 টি মন্তব্য: