অন্ধকারভুক

মজিবুর রহমান


     
    ভাই একটু পা’টা সরান তো, ওই বাদাম সর, দেখুন আপনার ব্যাগটা পাশে রাখলে ভালো হয় ...। এই সব বলে জনজ্যাম পেরিয়ে শেষের সিটে বসা যে লঞ্চে ভাগ্য মনে করতাম, সেই লঞ্চে আজ খুব কমই লোক। ডেকে অবশ্য কিছুটা বেশি হবে।
     প্রবোধহীন প্রসূনকান্নার মতো বৃষ্টি নেমেছে। হয়তো সে কারণেই যাত্রী কম। তবুও পেছনের দিকে বসলাম। লঞ্চ যেন ঘুমের বড়ি খেয়ে চলছে। ঘুমকাতুরে কিশোরির অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশ কাগুজে মায়ের ফাঁদা রুটিন পর্যন্ত টিকে থাকার মতো বড় বিরক্ত নিয়ে যেন লঞ্চটা চলছে ..., চলবে ভোর পর্যন্ত। এ সময়টা, এ অন্ধকারটা বৃষ্টিভুক আর আমি অন্ধকারভুক।

    এক ঘন্টার বৈঠক ঘুম শেষে দেখি যাত্রী বেড়েছে। আমার ও পাশের সিটে ষাটোর্ধ্ব একজন খড়খড়ে গলায় বেশ গল্প জমাচ্ছে। ডিম লাইট জ্বলছে একটা। চাঁদে কালো মতন কি একটা থাকে যে কিনা চাঁদ-কলন্ধ বলে পরিচিত ঠিক এমন বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে এ আলোটা যেন অন্ধকারের কলঙ্কই বটে।
    মোবাইলে airy ringtone সেট করা। এই বাজনাটা আমার খুব প্রিয়। এটা নিয়ে কল্পনাবেশের শেষ নেই আমার। আনন্দ-বেদনা দু’টো মুহূর্তেই বাজনাটা মেনে যায়। যখন বাজে তখন একটা ছবি জেগে ওঠে চোখ মনে, শরৎ বিকেল নীলজলা ছোট্ট একটি ডোবায় পাড়স্থ গাছের সামিয়ানা ফুটো করে ছেঁড়া পট্টি আলো, জল পড়ে পাতা নড়ে নয় পাতা পড়ে জল নড়ে ডোবায় গোল গোল হাসি।
 রূপকের ফোন এল-
- হ্যালো ছন্দা, কোথায় আছ?
- লঞ্চে, তোমার ওখানে কতক্ষণ লাগবে বলতে পারো?
- ঠিক ভোরে পৌছে যাবে। আমি জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকব। লঞ্চ থেকে নেমেই ফোন দিও। আমি খুঁজে নেব।
- লুফে নেব না?
- হ্যা তাই, ছোঁ মেরে নিয়ে যাব।
- কোথায়?ছিপছিপে শরের ভিতর’?
- হ্যা এক নিরাল নীড়ে।

    আনিসের কথা মনে পড়ছে। আমার স্বামী। ঘর জামাই থাকার মতো নিরীহ আর শ্যাওলালেপা পুরনো দেয়ালের মতো নির্জীব মনে হলে ও আসলে তা নয়। আমি যেমন কালো তেমন বেঢপ মোটা। রিক্সায় চলাচল অনেক আগেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।স্তন আর পেটের ভাঁজ এক হয়ে লেগে থাকে। দু’চার বছরের ছেলে মেয়ে আমার এই মাংস ঢিবিটা দেখলে ভয় পায়। মার্কেটে গেলে সেলসম্যানরা কৌতুকাবরণে বলে আসেন আপা লম্বা-চওড়া ঢাকাই শাড়ি আছে। মা-বাবা ছাড়া কেউ আমার সঙ্গে বেরোয় না। কদাচিৎ আনিস। ছোট ভাইটার অসস্থি লাগে। কারো প্রতি অভিযোগ নেই। পীড়াপীড়ি করি না কাউকে সঙ্গে যেতে। ঢাকায় পাঁচ কাঠা জমি হোক আর যাই হোক আনিস আমাকে বিয়ে করেছে এটাই যেন ওর বদান্যতা। বছর দুয়েক ঘর জামাই থেকেছে কয়েদি ধৈর্য চেপে। যেই না পাঁচ কাঠা জমি লিখে দেওয়া হল সেই ওর মনে স্বাধীন চেতনা চলে এল।
    ওর দেশের বাড়ি মানে আমার শ্বশুরবাড়ি সেবার গিয়ে ক’দিন থেকে এলাম। একদিন গাঢ় রাতে জেগে দেখি বিছানায় নেই ও। ঘরের পেছনে ফিসফাসের শব্দ পেলাম। অনেক নিরবতা অন্ধকারের মুখ চেপে আছে। তারই অসাবধান হাতের ফাঁকে চুড়ি নড়ার শব্দ। আমি উঠে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে কামার্ত গোঙ্গানি শুনতে পেলাম। নাহ্ আর বুঝে লাভ নেই। চাচাতো বোনের জন্য ওর বিশেষ আহলাদ আগেই লক্ষ্য করেছি, এখন বর্ণনার প্রয়োজন কী? জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি শেষতক আমিই মেয়েটার হাতে তুলে দিলাম। নারীত্বের অহংকার নিয়ে কী নেই আমার মাঝে বলতে পারলাম না। আনিসের সাথে আমার এখন তুই তুকারি বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কপটতার মাঝেও ওর সরলতা আছে। টাকার লোভ, ভাবিদের মাঝে কার ফিগার স্বল্পবসনা সিনেমা কন্যাদের সাথে মিলে যায়, এমনকি ওর চাচাতো বোন পর্যন্ত — শেয়ার করে।
    রূপক ছেলেটা সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। ও বলল তাই বললাম। রং নাম্বারে ফোন মেরে একদিন আমাকে পেল। সেই থেকে কথা শুরহল। আজ দেখা করতে যাওয়া। কথায় বালকসুলভ প্রগলভতা নেই। কবিতা লিখে বোধহয়। আবৃত্তির ধরণটাও মনপরশা। কথা বলতে ভালোই লাগে। আমার কণ্ঠ নাকি ওকে মুগ্ধ করে। আমার একটা ছবিও নাকি একে নিয়েছে মনে মনে। আনিসদের পাশের উপজেলায় ছেলেটার বাড়ি। তো যাচ্ছি তো শ্বশুর বাড়ি দেখা হয়ে যাক।
    নির্লিপ্ত রাতের গান, জেলেদের ডানপিঠে সুরের কাঁপন, বাদুরঝুলো দীর্ঘ রাত পেরিয়ে জেটিতে লঞ্চ ভিড়ল।
- হ্যালো ছন্দা, কোথায় তুমি?
- এই তো নামলাম মাত্র।
- শোন, পূর্ব দিকে চেয়ে দেখ বড় একটা এইডস এর সাইনবোর্ড। আমি ঠিক নিচেই নীল টিশার্ট পরা। এখানে আর কেউ নেই।

    জেটির পূর্ব দিকে আমি আর তাকালাম না। আমার যে ছবি ও এঁকেছে সেটা নষ্ট করতে চাইছিনা। আমার কণ্ঠ শুনে ছেলেটা মুগ্ধ হোক। আমাকে দেখার পর ওকি কখনো মনপরশা আবৃত্তি শোনাবে আমায়? ওজনি শরীরটা নিয়ে শ্বশুর বাড়ির দিকে রওনা হলাম। মোবাইল বাজছে airy ringtone । পিঠের চাকচাক মাংসগুলো নড়ছে। চার পাশের মানুষগুলো হয়ত দেখছে অবাক চোখে। রূপক ফোন করছে। আমার প্রিয় বাজনাটা বেজে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছবি, শরৎ বিকেল নীলজলা ছোট্ট একটা ডোরায় পাড়স্থ গাছের সামিয়ানা ফুটো করে ছেঁড়াপট্টি আলো, জল পড়ে পাতা নড়ে নয় পাতা পড়ে জল নড়ে ডোবায় গোল গোল হাসি। জীবনান্দের আমি যদি হতাম রূপকের কণ্ঠে বেশ লাগে। তাই না হয় শুনে শুনে দিন কাটুক। দেখা করে লাভ কী?



লেখক পরিচিতি


জন্মস্থানঃ গ্রাম - আজম পুর , থানা- মোহনগঞ্জ , জেলা - নেত্রকোনা , বাংলাদেশ।

বর্তমান বাসস্থানঃ ২৭/৩ জালালাবাদ আবাসিক এলাকা , সিলেট সদর , বাংলাদেশ।

পেশাঃ ছাত্র (লোক প্রশাসন ৩য় বর্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ,সিলেট)।

পুরস্কারঃ সেরা বিতার্কিক , লোকপ্রশাসন বিতর্ক সপ্তাহ ২০১২ , শাবিপ্রবি, সিলেট।



শেয়ার করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন