দীননাথ মণ্ডল
সদ্য ডাক্তারী পাশ করে বাড়ি ফিরেছি। কলকাতার চার বছরের যান্ত্রিক পরিবেশে আমার শিশুবেলার কোমল হৃদয় বিকৃত ঘটে গেছে। তাই যখন রাস্তা দিয়ে হাটি গ্রামের ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি, এমনকি বাড়ির বউ-ঝিয়েরা অলি-গলি থেকে আমাকে উঁকি মেরে দেখে। কিন্তূ কারো সঙ্গে মিশতে আমার মন চাই না। এ গ্রামে আমিই প্রথম ডাক্তার হয়েছি। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দেখি প্রায় সকলেই আমাকে রাস্তা ছেড়ে দেয়। আমার মনে তখন শহরের রঙিন জীবনের নানা স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। দিনরাত শহরকে নিয়েই যত জল্পনা-কল্পনা। গ্রামের বাল্য পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতে মোটেই ভালো লাগছে না। এদের সঙ্গে আমার আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
সেদিন বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছি। এমন সময় একটা বৃদ্ধ গলার ডাক কানে ভেসে এল- 'আরে, গণেশ নাকি, কবে এলে?’ পিছন ঘুরে দেখি আমাদের পরিতোষ কাকা। তার সঙ্গে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। কাছে যেতেই আগ্রহ সহকারে আমাকে বাড়ির দিকে ডেকে নিয়ে গেল। দোচালা মাটির বারান্দায় একটা মাদুর পেতে দিয়ে বসতে বলল। কলকাতায় কেমন ছিলাম এ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। এ বাড়ি আমার ছোট বেলার চেনা জানা। উঠানের উপর তুলসি তলার পাশে বিরাট বকুল গাছ। ছোট বেলায় এই গাছের কত ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথেছি। কতদিন এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেছি।
সন্মুখের ঘর থেকে একটা কাঁচের চুরির আওয়াজ কানে ভেসে এল। চোখ তুলতেই দেখি, কে যেন জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ঠিক চেনা যাচ্ছে না। লাল সালুয়ার পরিহিতা একটি মেয়ে।প্রথমটা ভাবতে পারলাম না। পরে মনে পড়ল পূজার কথা। এ বাড়ির ছোট মেয়ে সে। আজকের পূজা সেই বাল্যের মতো আর নেই। তার সঙ্গে তখন আমার দারুন সখ্যতা ছিল। সে আজ আমাকে লজ্জা করছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হেসে সরে যাচ্ছে। প্রথমটা ভাবলাম গ্রামের মেয়ে বলে সে এরকম আচরণ করছে। লজ্জা! কিসের আমি তো তার পূর্ব পরিচিত। আমাকে কথা বলতে ভয় কিসের! উঠানে নেমে একমুঠো বকুল ফুল কুড়িয়ে পরিতোষ কাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাস্তায় নেমে এলাম। ঘরের ভিতর থেকে একটা খিলখিল শব্দের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন শ্রাবণের নির্ঝর শানিত মেঘের গর্জন।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টেলিফোন পেলাম। সত্ত্বর উত্তরবঙ্গে যেতে হবে। সেখানে বন্যা দেখা দিয়েছে। মহামারি দেখা যেতে পারে জল নামলেই। অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে হবে। পরদিন ভোরের ট্রেনে রওনা দিলাম। কলকাতায় পৌছিয়ে দেখা করতে গেলাম আমার প্রেমিকার সঙ্গে। বাড়ি থেকে জানলাম সে পাশের মাঠে বেড়াতে গিয়েছে। নিকোপার্কে ঢুকতেই দেখি জিনিয়া অন্য একটি ছেলের হাত ধরে এগিয়ে আসছে গল্প করতে করতে। মুখ ঘুরিয়ে নিল আমাকে দেখে। মনে হল সে যেন আমাকে চিনে না। সন্ধ্যায় জিনিয়ার বাড়ি গেলাম। ঘরে ঢুকতেই একটা শুকনো গোলাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-'Please, you are get out. I am engaged now'.বেরিয়ে এলাম মাথা নিচু করে। বাসায় এসে দেখি আমার দেওয়া সেই গোলাপটি। সেটা ছিল কাঁচা আর এটা শুকনো।
পরদিন মেডিক্যাল টিম নিয়ে রওনা হলাম উত্তরবঙ্গে। আমাদের ডাক্তারি ক্যাম্প বসল একটা ফাঁকা মাঠে বকুল গাছের তলায়। যথারীতি আন্ত্রিক, ডাইরিয়ার ওষুধ দিতে লাগলাম। অদূরে দুটি ছোট ছেলে মেয়ে খেলা করছে বকুল ফুল নিয়ে। একে অপরকে ফুল দিচ্ছে। মুখে স্মিত শুভ্র হাসি। হঠাৎ আমার গোলাপের মোহ ভেঙ্গে গেল। মনে পড়ল বাল্যকালের স্মৃতি। আমিও তো একদিন এমনি করে পূজাকে ফুল দিয়ে বরণ করে ছিলাম। সে আমাকে বলত বকুল’ আর আমি তাকে ‘সুন্দরী’। আমাদের জুটির নাম ছিল ‘বকুল-সুন্দরী’। তাই পূজা আমাকে দেখে ওরকম আচরণ করেছিল সেদিন।
পরের দুদিন ডাক্তারি কাজে ঠিক মতো মন দিতে পারছিলাম না। পূজায় আমার ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি আসার দিন একরাশি বকুল ফুল নিয়ে রওনা হলাম। বাল্য বঁধুকে নতুন করে বরণ মালা দেবার জন্য। গাড়িতে আসার সময় সেদিনের ওই খিলখিল হাসির আওয়াজ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে লাগল।
এদিকে গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট জলমগ্ন। নৌকায় করে পূজাদের বাড়ির সামনে এসে দেখি- বাড়িতে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখি পূজা রাত্রিতে ঘর চাপা পড়ে মারা গেছে। পরনে সেই লাল রঙের পোশাকটি। অন্তরটা ডুকরে কেঁদে উঠল। চিতায় শুকনো বকুল ফুলগুলো শেষ বারের মতো সমর্পণ করলাম। সমস্ত স্বপ্ন ভেস্তে গেল। বুকের ভিতরটা ‘ধ্বস’ করে উঠল। মনের মধ্যে একটা কথা আর্তি হয়ে জেগে রইল - ‘সবহারালাম’।
সন্মুখের ঘর থেকে একটা কাঁচের চুরির আওয়াজ কানে ভেসে এল। চোখ তুলতেই দেখি, কে যেন জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ঠিক চেনা যাচ্ছে না। লাল সালুয়ার পরিহিতা একটি মেয়ে।প্রথমটা ভাবতে পারলাম না। পরে মনে পড়ল পূজার কথা। এ বাড়ির ছোট মেয়ে সে। আজকের পূজা সেই বাল্যের মতো আর নেই। তার সঙ্গে তখন আমার দারুন সখ্যতা ছিল। সে আজ আমাকে লজ্জা করছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হেসে সরে যাচ্ছে। প্রথমটা ভাবলাম গ্রামের মেয়ে বলে সে এরকম আচরণ করছে। লজ্জা! কিসের আমি তো তার পূর্ব পরিচিত। আমাকে কথা বলতে ভয় কিসের! উঠানে নেমে একমুঠো বকুল ফুল কুড়িয়ে পরিতোষ কাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাস্তায় নেমে এলাম। ঘরের ভিতর থেকে একটা খিলখিল শব্দের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন শ্রাবণের নির্ঝর শানিত মেঘের গর্জন।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টেলিফোন পেলাম। সত্ত্বর উত্তরবঙ্গে যেতে হবে। সেখানে বন্যা দেখা দিয়েছে। মহামারি দেখা যেতে পারে জল নামলেই। অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে হবে। পরদিন ভোরের ট্রেনে রওনা দিলাম। কলকাতায় পৌছিয়ে দেখা করতে গেলাম আমার প্রেমিকার সঙ্গে। বাড়ি থেকে জানলাম সে পাশের মাঠে বেড়াতে গিয়েছে। নিকোপার্কে ঢুকতেই দেখি জিনিয়া অন্য একটি ছেলের হাত ধরে এগিয়ে আসছে গল্প করতে করতে। মুখ ঘুরিয়ে নিল আমাকে দেখে। মনে হল সে যেন আমাকে চিনে না। সন্ধ্যায় জিনিয়ার বাড়ি গেলাম। ঘরে ঢুকতেই একটা শুকনো গোলাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-'Please, you are get out. I am engaged now'.বেরিয়ে এলাম মাথা নিচু করে। বাসায় এসে দেখি আমার দেওয়া সেই গোলাপটি। সেটা ছিল কাঁচা আর এটা শুকনো।
পরদিন মেডিক্যাল টিম নিয়ে রওনা হলাম উত্তরবঙ্গে। আমাদের ডাক্তারি ক্যাম্প বসল একটা ফাঁকা মাঠে বকুল গাছের তলায়। যথারীতি আন্ত্রিক, ডাইরিয়ার ওষুধ দিতে লাগলাম। অদূরে দুটি ছোট ছেলে মেয়ে খেলা করছে বকুল ফুল নিয়ে। একে অপরকে ফুল দিচ্ছে। মুখে স্মিত শুভ্র হাসি। হঠাৎ আমার গোলাপের মোহ ভেঙ্গে গেল। মনে পড়ল বাল্যকালের স্মৃতি। আমিও তো একদিন এমনি করে পূজাকে ফুল দিয়ে বরণ করে ছিলাম। সে আমাকে বলত বকুল’ আর আমি তাকে ‘সুন্দরী’। আমাদের জুটির নাম ছিল ‘বকুল-সুন্দরী’। তাই পূজা আমাকে দেখে ওরকম আচরণ করেছিল সেদিন।
পরের দুদিন ডাক্তারি কাজে ঠিক মতো মন দিতে পারছিলাম না। পূজায় আমার ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি আসার দিন একরাশি বকুল ফুল নিয়ে রওনা হলাম। বাল্য বঁধুকে নতুন করে বরণ মালা দেবার জন্য। গাড়িতে আসার সময় সেদিনের ওই খিলখিল হাসির আওয়াজ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে লাগল।
এদিকে গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট জলমগ্ন। নৌকায় করে পূজাদের বাড়ির সামনে এসে দেখি- বাড়িতে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখি পূজা রাত্রিতে ঘর চাপা পড়ে মারা গেছে। পরনে সেই লাল রঙের পোশাকটি। অন্তরটা ডুকরে কেঁদে উঠল। চিতায় শুকনো বকুল ফুলগুলো শেষ বারের মতো সমর্পণ করলাম। সমস্ত স্বপ্ন ভেস্তে গেল। বুকের ভিতরটা ‘ধ্বস’ করে উঠল। মনের মধ্যে একটা কথা আর্তি হয়ে জেগে রইল - ‘সবহারালাম’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন